১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ওই বছরের ৭ জুন ছয় দফা দাবি আদায়ের দিবস হিসেবে পালন করার আহ্বান করা হয়েছিল। সেদিন ঢাকাসহ তৎকালীন সারা পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়েছিল। রাজপথ সংগ্রামী জনতার রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল।
সেই যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা আর থামেনি। এই ছয় দফার আন্দোলনই স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই ৭ জুন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ‘ছয় দফা’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়মী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান একটি সংক্ষিপ্ত প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছিলেন। মুখবন্ধ লিখেছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। সেই পুস্তিকা থেকে দফাগুলো হুবহু তুলে দেয়া হলো।
প্রস্তাব-১: শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রীয় প্রকৃতি:
দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে, যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্টারি ধরনের। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম। এবং এই পরিষদও নির্বাচিত হবে সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারণের সরাসরি ভোটে।
প্রস্তাব-২: কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা:
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবল দুটি ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সব বিষয়ে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
প্রস্তাব-৩: মুদ্রা বা অর্থ-সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দুটির যে কোনো একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা চলতে পারে:
(ক) সমগ্র দেশের জন্য দুটি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যোগ্য মুদ্রা চালু থাকবে। অথবা (খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্য কেবলমাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এ ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রবর্তন করতে হবে।
প্রস্তাব-৪: রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনোরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গরাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর সব রকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
প্রস্তাব-৫: বৈদেশিক বাণিজ্যবিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাষ্ট্রের বহির্বাণিজ্যের পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর এখতিয়ারাধীন থাকবে।
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোনো হারে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোই মেটাবে।
(ঘ) অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর মধ্যে দেশজ দ্রব্যাদি চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা কর জাতীয় কোনো বাধানিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে বিদেশে নিজ নিজ বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্বস্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
প্রস্তাব-৬: আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা:
(ক) আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা-সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
(খ) কেন্দ্রীয় সরকারের সকল শাখায় বা চাকরি ক্ষেত্রে প্রতিটি ইউনিট থেকে জনসংখ্যার ভিত্তিতে জনবল নিয়োগ করতে হবে।
(গ) নৌবাহিনীর সদর দফতর করাচি থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর।