অনলাইন ডেস্ক ॥ টেক্সাসের প্রাইমারি স্কুলে বন্দুকধারীর ভয়াবহ আক্রমণের পর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন দেশটির আইনপ্রণেতাদের ‘গান লবি’ বা অস্ত্র ব্যবসায়ীদের প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছেন। ক্ষমতাসীন ডেমোক্রেট দলের সদস্যরা ‘গান লবি’ বা অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের পক্ষে থাকার কারণে রিপাবলিকান আইনপ্রণেতাদের সমালোচনা করছেন। কী এই ‘গান লবি’? যুক্তরাষ্ট্রে কতটা প্রভাবশালী গান লবি? কেন বিভিন্ন সিনেট নির্বাচনে এরা হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করে? এদের প্রভাবে কেন কঠোর অস্ত্র নীতিমালা আইন করা যাচ্ছে না? এসবের বিস্তারিত তুলে ধরেছে কাতারভিত্তিক সংবাদ মাধ্যম আল-জাজিরা।
টেক্সাসের রব এলিমেন্টারি স্কুলের ছাত্র ১৮ বছর বয়স্ক সালভাদর রামোসের গুলিতে ১৯ শিক্ষার্থীসহ এখন পর্যন্ত ২১ জন নিহত হয়েছে। এরপরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ঈশ্বরের নামে কখন আমরা গান লবির বিরুদ্ধে দাঁড়াবো? জাতি হিসেবে আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে কবে আমরা অস্ত্র নীতিমালা গ্রহণ করবো। ঈশ্বরের দোহাই! কবে আমরা আমাদের যে কাজটি করা দরকার সেটি করবো। ডেমোক্রেটদের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার শাসনামলে ২০১২ সালে কানেক্টিকাট নিউটাউন শহরের সেন্ডি হুক এলিমেন্টারি স্কুলে এক বন্দুকধারীর গুলিতে ২০ শিশু ও ৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক মারা যায়। তখন ওবামা বলেছিলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র প্যারালাইজড (অক্ষম) হয়ে গেছে। তবে ভয়ে নয়, গান লবি এবং ওইসব রাজনৈতিক দলগুলোর কারণে যারা এ ধরনের হামলা বন্ধ করতে চায় না।’ টেক্সাসের মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের পর ডেমোক্রেটিক পার্টির হাউজ ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান অ্যাডাম শেফ টুইটারে লিখেছেন, রব এলিমেন্টারি স্কুলে গুলির ঘটনাটি অত্যন্ত ভয়াবহ। বাচ্চারা মারা যাচ্ছে আর আমরা এ নিয়ে কিছুই করতে পারছি না। তবুও রিপাবলিকানরা গান লবির বিরুদ্ধে দাঁড়াবে না!
যুক্তরাষ্ট্রের ‘গান লবি’ আসলে কী?
মার্কিন গান লবি বলতে বোঝায় অস্ত্র ব্যবসায়ীদের শক্তিশালী এক সিন্ডিকেট যারা আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের অস্ত্র নীতিমালা নিজেদের পক্ষে রাখার জন্য কাজ করে। নির্বাচনে এরা সাধারণত ওইসকল প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালায় যারা কঠোর অস্ত্র আইন বিরোধী এবং অস্ত্র নিয়ন্ত্রণের কোনো আইন পাশ হোক তা চায় না। এরা নির্বাচিত আইনপ্রণেতাদের সরাসরি অর্থ প্রদান করে এবং ওই সকল প্রার্থীদের নির্বাচিত হতে সাহায্য করে যারা তাদের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনের বিপক্ষে থাকে। বিভিন্ন তদন্তে দেখা গেছে, ন্যাশনাল রাইফেল এ্যাসোসিয়েশন (এনআরএ) অস্ত্র আইন বিরোধী লবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী। যাদের সাথে মাল্টি বিলিয়ন ডলারের আগ্নেয়াস্ত্র ইন্ডাস্ট্রির অস্ত্র ব্যবসায়ীদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। এনআরএ এবং এই জাতীয় লবিগুলো নিজেদেরকে নাগরিক অধিকার রক্ষক হিসেবে দাবি করে। যারা মার্কিন সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী ‘অস্ত্র বহন নাগরিকদের অধিকার’ ধারাটি বিশেষভাবে তুলে ধরে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার অজুহাত দিয়ে অস্ত্র বহন ও ব্যবহারের বিষয়টির পক্ষে প্রোপাগান্ডা চালায় এই লবিগুলো।
একইসাথে অস্ত্র বিরোধী গ্রুপ সাবেক মার্কিন নারী কংগ্রেস সদস্য এবং বন্দুকধারীর হামলায় বেঁচে যাওয়া গ্যাবি গ্রিফোর্ডসের সংগঠন এনআরএ লবির বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে, এরা কেবল অস্ত্র ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যই বাস্তবায়ন করছে। যাদের উদ্দেশ্যে অস্ত্র বিক্রি বৃদ্ধি এবং গান লবি কর্তৃপক্ষের সেবা করা। অস্ত্র বিরোধী পক্ষগুলো বিপাবলিকানদের নিয়ন্ত্রিত রাজ্যগুলোতে অস্ত্র আইন স্বাভাবিক করার জন্য লবিগুলোকে দায়ী করেছে। যেসব রাজ্যে প্রায়ই গান ভায়োলেন্সে অনেক মানুষ নিহত হয়। চলতি সপ্তাহেই টেক্সাসের গভর্নর গ্রেগ অ্যাবোট, টেক্সাসের রিপাবলিকান সিনেটর টেড ক্রুজ এবং সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প টেক্সাসে এক বৈঠকে মিলিত হবেন। এই বৈঠকের আয়োজন করেছে এনআরএর স্ব-ঘোষিত লবিং হাত ইনস্টিটিউট ফর ল্যাজিসলাটিভ অ্যাকশন।
কতটা প্রভাবশালী ‘গান লবি’
গান লবির বিভিন্ন গ্রুপ কতটা প্রভাবশালী সেটি নির্ণয় করা কঠিন। তবে এরা রাজনৈতিক সমর্থনের সাথে সাথে সরাসরি অর্থ সাহায্যও দিয়ে থাকে ওই সকল প্রার্থীদের যারা কঠোর অস্ত্র আইন বিরোধী। যদিও এনআরএ সম্প্রতি অর্থ সংকটে পড়েছে বলে জানা গেছে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত এই লবি ১৭১.৯ মিলিয়ন ডলার সরাসরি দিয়েছে বিভিন্ন প্রার্থীকে। এছাড়া গোপনে দিয়েছে এরচেয়েও অনেক বেশি অর্থ। ১৯৯৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অর্থ খরচের গবেষণা করা অলাভজনক সংগঠন ‘ওপেন সিক্রেট’ জানিয়েছে, এনআরএ একাই এক্ষেত্রে ৬৩ মিলিয়ন ডলার দিয়েছে।
‘ওপেন সিক্রেট’-এর মতে, ২০১০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যেই ১৫৫.১ মিলিয়ন ডলার অস্ত্র আইনের সমর্থনে খরচ করেছে। ২০১৬ সালে এনআরএ ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং আরও ৬ জন রিপাবলিকান সিনেটর প্রার্থীকে জেতাতে ৫০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করে। টিভিতে এডভার্টাইজ দেয়ার পেছনে অঢেল অর্থ ঠেলেছে এনআরসি। ২০১৭ সালে ট্রাম্প অস্ত্র আইনের পক্ষে নিজেদের সমর্থন জানিয়ে এনআরএর উদ্দেশ্যে বলেন, আমি কখনও তোমাদের নিরাশ করবো না। এছাড়া বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নির্বাচনেই অস্ত্র ব্যবসায়ীদের লবি রিপাবলিকান সিনেটরদের নির্বাচনী তহলিবে বড় অংকের অর্থ দিয়ে থাকে। সরাসরি প্রার্থীকে অর্থ প্রদান ছাড়াও বিভিন্ন ক্যাম্পেইনের মাধ্যমেও অঢেল অর্থ খরচ করে থাকে এই লবি।