ডেস্ক নিউজ ॥ গতকাল বিশ্বজুড়ে পালিত হল শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। ‘সামাজিক সুরক্ষা ও কল্যাণ নিশ্চিত করি, শিশুশ্রম বন্ধ করি’ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে পালিত হবে দিবসটি। দিবসটি পালন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচি পালনে এসব সংস্থার সঙ্গে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সমন্বয় করবে। বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৬০ মিলিয়ন বা ১৬ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন) এবং ইউনিসেফ সতর্ক করে দিয়েছে যে, করোনা মহামারীর কারণে আরও ৯০ লাখ শিশু শ্রমের ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে। বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবসকে সামনে রেখে প্রকাশিত ‘চাইল্ড লেবার: গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২০, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, শিশুশ্রম বন্ধে অগ্রগতি গত ২০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো থমকে গেছে, যা আগের নিম্নমুখী প্রবণতাকে উল্টে দিচ্ছে। ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা কমে ৯ কোটি ৪০ লাখে নেমে এসেছিল। প্রতিবেদনে শিশুশ্রমে নিযুক্ত ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছে, যে শিশুদের সংখ্যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত মোট শিশুর অর্ধেকের কিছু বেশি শিশুদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও নৈতিকতার ক্ষতি করতে পারে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ২০১৬ সালের পর ৬৫ লাখ বেড়ে ৭ কোটি ৯০ লাখে পৌঁছেছে।
আইএলও’র মহাপরিচালক গাই রাইডার বলেন, “নতুন এই হিসাব একটি সতর্ক সংকেত। যখন নতুন একটি প্রজন্মের শিশুদের ঝুঁকির মুখে ঠেলে দেয়া হচ্ছে তখন আমরা হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্যেও পরিবারগুলোকে তাদের শিশুদের স্কুলে পাঠানোর সুযোগ করে দেয়। পল´ী উন্নয়নে বর্ধিত বিনিয়োগ এবং কৃষিখাতের উন্নয়নে যথোপযুক্ত কাজের সুযোগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে আছি এবং আমাদের প্রতিক্রিয়ার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। এই অবস্থাকে বদলে দিতে এবং দারিদ্র্য ও শিশুশ্রমের চক্র ভেঙ্গে দিতে নতুন প্রতিশ্রুতি ও শক্তির সম্মিলন ঘটানোর এখনই সময়।” সাব-সাহারা আফ্রিকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বারবার ফিরে আসা সংকটময় পরিস্থিতি, চরম দারিদ্র্য এবং অপর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা গত চার বছরে অতিরিক্ত ১ কোটি ৬৬ লাখ শিশুকে শ্রমের দিকে ঠেলে দিয়েছে। এমনকি এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবীয় অঞ্চলের মতো যেসব অঞ্চলে ২০১৬ সালের পর থেকে কিছু অগ্রগতি হয়েছে সেখানেও কোভিড-১৯ এই অগ্রগতিকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে। প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, মহামারির কারণে ২০২২ সাল সমাপ্ত হওয়ার আগেই বিশ্বব্যাপী অতিরিক্ত ৯০ লাখ শিশু শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
পরিস্থিতি অনুকরণে তৈরি একটি মডেলে (সিমিউলেশন মডেল) দেখা গেছে, এই সংখ্যাটি বেড়ে ৪ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছতে পারে, যদি তাদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনা না হয়। করোনার কারণে বাড়তি অর্থনৈতিক চাপ এবং স্কুল বন্ধের কারণে ইতোমধ্যে শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের হয়তো দৈনিক আরও দীর্ঘ সময় ধরে বা আরও খারাপ অবস্থার মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে ঝুঁকির মুখে থাকা পরিবারগুলোতে কাজ হারানো বা আয় কমে যাওয়ার কারণে আরও অনেক শিশু হয়তো সবচেয়ে খারাপ ধরনের শিশুশ্রমে নিযুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে।
ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক হেনরিয়েটা ফোর বলেন, “শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি এবং গত বছরটি এই লড়াইকে কোনোভাবে সহজতর করে তোলেনি।এখন বিশ্বব্যাপী লকডাউন, স্কুল বন্ধ থাকা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিঘ্ন এবং জাতীয় বাজেট ক্রমেই সংকুচিত হওয়ার দ্বিতীয় বছরে অনেক পরিবার হৃদয়-বিদারক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে। শিশুদের কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরিয়ে এনে স্কুলে ফেরাবার লক্ষ্যে কর্মসূচি এবং পরিবারগুলো যাতে শিশুদের কর্মক্ষেত্র পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে সর্বাগ্রে সরে আসতে পারে এমন সামাজিক সুরক্ষায় বিনিয়োগে করাকে অগ্রাধিকার প্রদানে সরকার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলোর প্রতি আমরা আহ্বান জানাই।”
শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি এবং গত বছরটি এই লড়াইকে কোনোভাবে সহজতর করে তোলেনি।এখন বিশ্বব্যাপী লকডাউন, স্কুল বন্ধ থাকা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিঘ্ন এবং জাতীয় বাজেট ক্রমেই সংকুচিত হওয়ার দ্বিতীয় বছরে অনেক পরিবার হৃদয়-বিদারক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হচ্ছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুদের ৭০ শতাংশই (১১ কোটি ২০ লাখ) কৃষিখাতে নিয়োজিত। বাকিদের মধ্যে ২০ শতাংশ (৩ কোটি ১৪ লাখ) সেবাখাতে এবং ১০ শতাংশ (১ কোটি ৬৫ লাখ) শিল্পখাতে নিয়োজিত রয়েছে। শিশুশ্রমে নিয়োজিত ৫ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুদের প্রায় ২৮ শতাংশ এবং ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের ৩৫ শতাংশ স্কুলের বাইরে রয়েছে। সব বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রেই মেয়েদের তুলনায় ছেলে শিশুদের শিশুশ্রমে নিযুক্ত হওয়ার হার বেশি। সপ্তাহে অন্তত ২১ ঘণ্টা গৃহস্থালী কাজে সম্পৃক্ত থাকে এমন শিশুদের বিবেচনায় নিলে শিশুশ্রমে লিঙ্গ ব্যবধান কমে আসে। গ্রামাঞ্চলে শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত হওয়ার হার (১৪ শতাংশ) শহরাঞ্চলের (৫ শতাংশ) তুলনায় প্রায় তিনগুণ বেশি।
আইএলও’র বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর টুমো পোটিআইনেন বলেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলির অগ্রগতি যাতে না হারিয়ে যায়, সে কারণে বাংলাদেশকে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে লড়াইকে এজেন্ডার শীর্ষে রাখতে হবে। কেবল শিশু শ্রমিক এবং ঝুঁকির মুখে থাকা শিশুদের জন্যই নয়, পিতা-মাতা এবং জ্যেষ্ঠ ভাই-বোনদের জন্য উপযুক্ত কাজের সুযোগ প্রদান করার লক্ষ্যেও, বাধ্যতামূলক শিক্ষা, দক্ষতা বিকাশ, এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে গুরুত্ব দিয়ে আমরা আমাদের অংশীদারদের সাথে নিবিড়ভাবে কাজ চালিয়ে যাব। দেশের জনমিতিক লভ্যাংশের (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) সর্বোচ্চ সুবিধা পাবার লক্ষ্যে দক্ষ, স্বাস্থ্যকর ও উৎপাদনশীল শ্রমশক্তি তৈরির ব্যবস্থা জোরদার করার সময় এখনি।”
শিশুশ্রমে নিয়োজিত শিশুরা শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকে। শিশুশ্রম শিশুদের পড়াশোনাকে ব্যাহত করে, তাদের অধিকার ও ভবিষ্যতের সুযোগগুলোকে সীমিত করে দেয়, এবং তাদের দারিদ্র্য ও শিশুশ্রমের আন্তঃ-প্রজন্মগত দুষ্টচক্রে পড়ার দিকে ধাবিত করে। বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি টোমো হোযুমি বলেন, “মহামারির মাঝে গত মার্চ ২০২০ থেকে স্কুল বন্ধ থাকা এবং দরিদ্রতা বৃদ্ধি আরও অনেক শিশুকে শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দিচ্ছে – যা নিয়ে ইউনিসেফ উদ্বিগ্ন। এই পরিস্থিতিতে পরিবারগুলোর বেচে থাকার লড়াই করতে হচ্ছে এবং তার জন্য তারা সকল পন্থাই অবলম্বন করতে বাধ্য হচ্ছে। তাই আমাদের এখন শিশুদের প্রয়োজনগুলোকে অগ্রাধিকার দেয়া এবং এই ক্ষতিকারক শিশুশ্রমের মূলে যে সকল সামাজিক সমস্যাগুলো রয়েছে তা নিরসনে জোর দেয়া প্রয়োজন।”
শিশুশ্রমের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতাকে উল্টে দিতে আইএলও ও ইউনিসেফের আহ্বান:
সর্বজনীন শিশু সুবিধাসহ সবার জন্য পর্যাপ্ত সামাজিক সুরক্ষার ব্যবস্থা করা।
মানসম্মত শিক্ষার পেছনে ব্যয় বাড়ানো এবং কোভিড-১৯-এর আগে থেকেই স্কুলের বাইরে থাকা শিশুদেরসহ সব শিশুকে স্কুলে ফিরিয়ে আনা।
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য যথোপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা করার বিষয়টি তুলে ধরা, যাতে পরিবারগুলোকে পারিবারিক উপার্জন বৃদ্ধিতে সহায়তা করতে শিশুদের অবলম্বন করতে না হয়।
শিশুশ্রমকে প্রভাবিত করে এমন ক্ষতিকারক লৈঙ্গিক রীতিনীতি এবং বৈষম্যের অবসান ঘটানো।
শিশু সুরক্ষা ব্যবস্থা, কৃষিজ উন্নয়ন, পল´ী জনসেবা, অবকাঠামো এবং জীবন-জীবিকার পেছনে বিনিয়োগ করা।
আইএলও ও ইউনিসেফ-এর সদস্য রাষ্ট্রসমূহ, ব্যবসাযড়ক খাত, ট্রেড ইউনিয়ন, সুশীল সমাজ এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক লড়াইয়ে তাদের প্রচেষ্টা আরও শক্তিশালী করতে আহ্বান জানাচ্ছে। নতুন বৈশ্বিক হিসাব প্রকাশ এবং এগিয়ে যাওয়ার রূপরেখা নিয়ে আলোচনা করতে আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনের সময় ১০-১৭ জুন সপ্তাহব্যাপী কার্যক্রম চলাকালে আইএলও মহাপরিচালক গাই রাইডার ও ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচারক হেনরিয়েটা ফোর অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের বক্তা ও যুব প্রতিনিধিদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন। ‘চাইল্ড লেবার: গ্লোবাল এস্টিমেটস ২০২০, ট্রেন্ডস অ্যান্ড দ্য রোড ফরওয়ার্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি শিশুশ্রম হিসাব সংক্রান্ত আইএলও-ইউনিসেফের প্রথম যৌথ প্রতিবেদন। বিশ্বজুড়ে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুদের ৭০ শতাংশেরও বেশি শিশুর ওপর পরিচালিত ১০৬টি জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এই হিসাব তৈরি করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ও শিশুশ্রম
সাম্প্রতিক দশকগুলিতে বাংলাদেশ শিশুশ্রম বিষয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান সংস্থা (বিবিএস)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে শিশুশ্রম ৫০ শতাংশ কমেছে। হিসাব অনুযায়ী ২০১৩ সালে ৩২ লক্ষ শিশু শিশুশ্রমে জড়িত ছিল, যা ২০১৩ সালে কমে আসে ১৭ লক্ষে। তবুও ২০১৩ সালে ১২ লক্ষ শিশু ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়িত ছিল, যা শংকাজনক। ২০২২ সালের শুরুতে আইএলও এবং বিবিএস একটি নতুন শিশুশ্রম সম্পর্কিত সমীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করার পরিকল্পনা করছে।