• Fri. Nov 22nd, 2024

দৈনিক পাবনার আলো, মাহফুজ আলী কাদেরী কর্তৃক সম্পাদিত

#pabnaralo#, pabna# pabnanews# পাবনারআলো# পাবনার_আলো#পাবনারখবর#পাবনারবার্তা

পদ্মা সেতু নির্মাণে যতো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিলেন প্রকৌশলীরা

অনলাইন ডেস্ক ॥ পদ্মা সেতু নির্মাণে সর্বোচ্চ মান নিশ্চিতের চেষ্টা আর কারিগরি চ্যালেঞ্জ সামলাতে গিয়ে বিশ্বে অনন্য নজির স্থাপন করেছে বাংলাদেশ। বলা হয়, পৃথিবীর গভীরতম পাইলের সেতু পদ্মা, নরম ও গ্রোতের তোড়ে সরে যাওয়ার মতো মাটির পরিমাণ এই নদীর তলায় অনেক বেশি।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণে এই মেগা প্রজেক্টের সাথে জড়িত প্রকৌশলীদের কারিগরি চ্যালেঞ্জগুলো। এই ধরণের মাটির উপর এতো ভারী একটি কাঠামোকে দৃঢ়ভাবে দাঁড় করানো ছিলো প্রকৌশলীদের কাছে বড় একটি চ্যালেঞ্জ। এই সেতু তৈরিতে এমন কিছু প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, যেগুলোর ব্যবহারিক প্রয়োগ বিশ্বে খুব একটা হয়নি। ফলে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার পরেও প্রতিটি মুহূর্তে নানান ধরণের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে সেতু নির্মাণের সাথে সংশি-ষ্টদের।
পদ্মার তলদেশে দানব আকৃতির পাইল:
পদ্মার মূল সেতু প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী জনাব দেওয়ান মোহাম্মদ আবদুল কাদের বলেন, ‘পাইলগুলোর ব্যাস একটি বড় ঘরের সমান। একেকটি পাইলের ব্যাস প্রায় ১০ ফুট। একেকটি পিলারের নিচে ৬ থেকে ৭টা বড় বড় পাইল আছে।’ পদ্মা সেতু তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছে মাইক্রো ফাইন সিমেন্ট। এই সিমেন্ট সম্পর্কে কাদের বলেন, ‘মাইক্রো ফাইন সিমেন্ট সাধারণত অত্যন্ত মিহি সিমেন্ট। সাধারণ সিমেন্টের চেয়ে এই সিমেন্ট অনেক বেশি দামি।’ উদাহরণ দিয়ে এই কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ৫০ কেজির সিমেন্টের বস্তা প্রতি মূল্য ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা। কিন্তু মাইক্রো ফাইন সিমেন্ট অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা হয়েছে। এখানে একেকটা ব্যাগের পেছনে ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ পড়েছে। পদ্মা সেতুর ৭১টি পাইলে মাইক্রো ফাইন সিমেন্ট দিয়ে স্কিন গ্রাউট করতে হয়েছে।
এদিকে, এই বিষয়ে পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম জানান, সাধারণভাবে পাইলিং করতে না পারায়, আরেকটা বিকল্প পদ্ধতি কাজে লাগানো হয়েছে। কিন্তু এই পদ্ধতি বিশ্বের কোথাও আগে পরীক্ষা করা হয়নি। সেটা স্কিন গ্রাউটিং

পদ্ধতি। এদিকে, সমস্যা দাঁড়ায় বাংলাদেশে সিমেন্টের যে কণা এবং পদ্মার তলদেশে মাটির যে কণা -তা দিয়ে স্কিন গ্রাউটিং করা সম্ভব হতো না। তখন বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে অস্ট্রেলিয়া থেকে মাইক্রো ফাইন সিমেন্ট নিয়ে আসা হয়।
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামার:
প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই পাইল যেহেতু পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাইল (১২২-১২৫ মিটার), তাই এটার লোড টেস্ট করার মতো কোনো যন্ত্র পৃথিবীতে ছিল না। তাই এটা তিন ভাগে করতে হয়েছে। ফলে সময় বেশি লেগেছে, প্রায় ৯ থেকে ১০ মাস। আমাদের হাতে বিকল্প না থাকায় আমরা সেটাই করেছি। যদি সেটা না করা হতো, তাহলে আমাদেরকে প্রজেক্ট বাদ দিতে হতো, নাহয় ডিজাইনে পরিবর্তন আনতে হতো। যা আরও সময় সাপেক্ষ।’
জানা যায়, পদ্মার তলদেশে স্কাওয়ার বা ‘সরে যাওয়া’ মাটির পরিমাণ বেশি থাকায় এর নির্মাণ কাজ ছিল বেশ জটিল। শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এই নদীতে ৬২ মিটার স্কাওয়ার, মানে ৬২ মিটার পাইল কোনো লোড নিতে পারবে না। আমি যখন পাইলিং করছি, তখন স্কাওয়ার হয়না। স্কাওয়ার যেকোনো সময় হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। তবে ‘হতে পারে’ নিয়েই আমরা কাজ করেছি।’ এই ব্যাপারে নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল কাদের জানান, পদ্মা সেতুর পাইলিংয়ে সবচেয়ে গভীরের পাইলটি নদীর ৪০০ ফুট নিচে গেছে। যা প্রায় ৪০ তলা বাসার সমান।
বন্যার কারণে তৈরি হয় জটিলতা:
জনাব শফিকুল বলেন, ‘সেসময় ১৩৫টির মতো ব্রডওয়ে ডেক পানিতে ভেসে যায়। রেলের স্টিলের যে বিম ছিল তাও ভেসে চলে যায়। আমাদের এই সেতুর একটি বৈশিষ্ট্য হলো এটি দেখতে বেশ

সুন্দর, ইংরেজি বর্ণ ‘এস (ঝ)’ এর মতো। মানুষের দেখতে ভালো লাগলেও এই ডিজাইন আমাদের জীবনটা অনেক কঠিন করে দিয়েছে। ‘এস’ এর মতো হওয়াতে ৪১টি স্প্যান ৪১ রকমের। ফলে যেটা যেখানে লাগার কথা সেটা সেখানেই বসাতে হয়েছে। অন্যখানে লাগালে হতো না। আকৃতি সোজা হলে আমরা যেকোনো জায়গায় লাগায় দিতে পারতাম, এতো কষ্ট হতো না। কিন্তু বন্যায় ভেসে যাওয়ার কারণে আমাদেরকে আবার সেগুলো বানাতে হয়েছে।’
কী কারণে ‘এস’ আকৃতি করা হলো?:
পদ্মা সেতুর আকৃতি ইংরেজি বর্ণ ‘এস (ঝ)’ এর মতো হওয়ার ব্যাপারে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘কোনো লম্বা জায়গায় সোজা সেতু হলে চালকের মধ্যে একঘেয়ামি চলে আসে। চালকদের ঘুম চলে আসে। এটা আমরা পড়েছি, তবে এটি স্বতঃসিদ্ধ নয়। অনেকে এটির সাথে দ্বিমত পোষণ করতে পারেন, তবে সেতু একটু আঁকাবাঁকা হলে তারা (চালকরা) সতর্ক থাকে।
বিদেশ থেকে আনা হয়েছে নির্মাণ সামগ্রী:
জনাব শফিকুল বিবিসিকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বানানোর মতো অবকাঠামো না থাকায় চীন থেকে বানাতে হয়েছে। কিন্তু চীনে বানালে এমন ১৫০ মিটার স্প্যান তো আনা সম্ভব না। আবার এর ওপর যদি ডেক দেই তাহলে তা ক্রেন দিয়ে উঠাতে পারবে না। এজন্য আমরা ১৫ থেকে ২০ টনের একেকটা পার্ট বানিয়ে চীন থেকে আনিয়েছি। এভাবে ১০০ থেকে ১১০ পার্ট জোড়া দিয়ে ৩২০০ টনের ১৫০ মিটার স্প্যান বানিয়েছি।’
এদিকে, সেতু প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শামীম জেড বসুনিয়া গণমাধ্যমকে বলেন, ‘চীনারা কাজ পেয়ে জানাল, স্টিল দিয়ে কাজ করবে না। স্টিলের প্লেট কেটে কেটে করবে। সবকিছু

চীনে হবে, সেখানে কোয়ালিটি কন্ট্রোল হবে। পরে প্লেট, কোয়ালিটি দেখে সন্তুষ্ট হলাম। এখানকার ইঞ্জিনিয়ার ওখানে পাঠাতে হবে। সে ওখানে থাকবে, দেখভাল করবে। ওখান থেকে প্লেটগুলো এসেছে, পাইলের প্লেটগুলো প্রথমে এসেছে। পাইলগুলো ১০ ফুট ডায়ামিটারের। প্লেটগুলো বাঁকিয়ে ওয়েল্ডিং করেছে। এই ওয়েল্ডিং বেশিরভাগই বাঙালিরা করেছে, চীনারাও ছিল।’
পদ্মা সেতুতে যে ধরনের বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়েছে তা পৃথিবীর অন্য কোথাও ব্যবহার হয়নি বলে জানান শামীম জেড বসুনিয়া। এসব বিয়ারিং ৯ মাত্রার ভূমিকম্পেও সেতুকে টিকিয়ে রাখবে। মাঝে বেশ কয়েকবার আলোচনায় এসেছে পদ্মা সেতুর খুঁটিতে ফেরির ধাক্কার ঘটনা। তবে পদ্মা সেতুতে অত্যাধুনিক সব প্রযুক্তি ব্যবহার করায় এসব নিয়ে সংশয়ের কিছু নেই বলে জানান এই অধ্যাপক।
জানা যায়, পদ্মা সেতুতে প্রায় ৩ লাখ টন রড, আড়াই লাখ টন সিমেন্ট, সাড়ে ৩ লাখ টন বালু, প্রায় ২ হাজার ১০০ টন বিটুমিন লেগেছে। এসব উপকরণ দেশ থেকেই সংগ্রহ করা হয়েছে। শামীম জেড জানান, এই সেতুতে ২০টির বেশি দেশের জনবল, যন্ত্র ও উপকরণ ব্যবহার হয়েছে। সাড়ে ৩ হাজার টন ওজনের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্যামার এই সেতুতে ব্যবহার হয়েছে। ক্রেন ব্যবহার হয়েছে ৪ হাজার টনের। সেতুতে ব্যবহার করা কংক্রিটের কিছু পাথর দেশ থেকে নেয়া হয়েছে। বেশিরভাগই আনা হয়েছে ভারত, ভুটান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। কংক্রিটের গুণগত মান যাচাই করে তারপর কাজ করা হয়েছে। বিশেষ কিছু রড আনা হয়েছে চীন থেকে। সংযুক্ত আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্য থেকে অ্যালুমিনিয়াম নেয়া হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *