গতকাল ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশে প্রতিবছর ৫ জুন যথাযথ মর্যাদার সাথে দিবসটি পালিত হয়ে থাকে। নদীর দেশ বাংলাদেশ। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা (ব্রহ্মপুত্র) কর্ণফুলী, সুরমা, তিস্তা, বরাকসহ অসংখ্য ছোটো-বড়ো নদ-নদী আমাদের দেশকে জালের মতো ছেয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ৫৭টি আন্তর্জাতিক নদীর ৫৪টির উৎপত্তি হিমালয়সহ ভারতের অন্যান্য উৎস থেকে।
বাংলাদেশের মিঠাপানির মাত্র ৭ ভাগ পাওয়া যায় বৃষ্টিপাত থেকে, আর বাকি ৯৩ ভাগ আসে সীমান্তের ওপার থেকে বৃষ্টি ও বরফ গলনের মাধ্যমে। ১৯৭৪ সালে ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকে পদ্মা অববাহিকা অঞ্চলে প্রায় ৩০ টি নদী মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। এককালে বড়ো নদীগুলো দিয়ে ৩২৮ হাজার থেকে ১৪২ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গা-কপোতাক্ষ অঞ্চলের ২ লাখ হেক্টর জমিতে সেচের পানি থেকে বঞ্চিত, ফলে শস্য উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় খাদ্যসংকট দেখা দেয়। উজানে অতিবৃষ্টি এবং হিমালয়ের বরফ গলার কারণে অতিরিক্ত পানির চাপ কমানোর জন্য হঠাৎ করে সবগুলোর নদীর বাঁধ খুলে দেওয়ার ফলে ফসল, জান-মাল এবং ভয়াবহ ভাঙনে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে অতিরিক্ত পানির চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে গভীর নলকূপের ব্যবহার করায় পানির স্তর ক্রমেই নেমে যাওয়ায় অগভীর নলকূপ প্রয়োজনীয় পানি না ওঠায় অধিক ফলনশীল ইরি ও বোরো ধানের চাষ ব্যাহত হয় এবং পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দেয়। ফারাক্কা বাঁধের ফলে মিঠাপানির চাপ কমে যাওয়ায় দক্ষিণাঞ্চলের নদীসমূহে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ঘটছে। উপকূলবর্তী নদীগুলোর লবণাক্ততা ইতোমধ্যে ৬০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষিত বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের সমাহার সুন্দরবনে ইতোমধ্যেই পরিবেশগত বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। ফারাক্কা বাঁধের কারণে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলাতেও ইতোমধ্যে ধ্বংসাত্মক বন্যা, ভাঙন এবং জলাবদ্ধতার ক্ষতি ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। পানি প্রবাহ ব্যাহত হওয়ার কারণে বাংলাদেশের নদীগুলো বিপুল পরিমাণ পলি বহন করতে না পারায় মাইলের পর মাইল ধুধু বালুচর সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশের অস্তিত্বও হুমকির সম্মুখীন।
উজানের নদীগুলো থেকে পানি প্রত্যাহারের ফলে দেশের প্রায় সবগুলো নদ-নদীই ক্রমে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী। ১৯৯৭ সালে গৃহীত
আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ কনভেনশনের ৭(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রতিটি দেশ আন্তর্জাতিক পানি প্রবাহ থেকে পানি ব্যবহারের সময় পাশ্ববর্তী দেশ যাতে কোনোরূপ ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প জাতিসংঘের পানি প্রবাহ কনভেনশনের (১) অনুচ্ছেদেরও সুস্পষ্ট লংঘন। ভারতের এক তরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়ায় দেশের অস্তিত্ব বিপন্নের পাশাপাশি পরিবেশগত বিপর্যয়, জীববৈচিত্র্য বিনষ্ট, জলজ প্রাণীর আবাসভূমি ধ্বংস এবং সুন্দরবনের বিনাশ হতে চলেছে। সরকারিভাবে স্বীকৃত বাংলাদেশের ছোটো বড়ো ৭১০ টি নদীর মধ্যে ৫৭ টি নদীই আন্তর্জাতিক, যার ৫৪ টি ভারত বাংলাদেশের মধ্যে অবস্থিত। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, ভারত-নেপাল থেকে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানির পরিমাণ বার্ষিক গড়ে ১০ লাখ ৭৩ হাজার ১৪৫ মিলিয়ন ঘনমিটার। অভ্যন্তরীণ বৃষ্টিপাত থেকে বার্ষিক ২ লাখ ৫০ হাজার ৪০১ মিলিয়ন ঘনমিটার পানি বাংলাদেশের নদী-নালা-খাল-বিল জলাশয়গুলোতে জমা হয়ে থাকে। বরাক-মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র-যমুনা ও গঙ্গা-পদ্মা নদীর মধ্য দিয়ে যথাক্রমে ১৫০ বিলিয়ন ঘনমিটার, ৭০০ বিলিয়ন ঘনমিটার ও ৫০০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি প্রবাহিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যৌথ নদী কমিশনের তালিকার বাইওে ৪২ টি নদ-নদীর মধ্যে ৩৭ টি নদী সরাসরি ভারতের সীমা অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এই নদীগুলোর পতিত মুখ বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই।
গভীরভাবে উপলব্ধি করলে দেখা যায় যে, তিনটি পরিকল্পনা সামনে রেখে ভারতের নদী ব্যবস্থাপনা পরিচালিত। প্রথমত, কৃষিজমিতে সেচ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ; দ্বিতীয়ত, জলবিদ্যুৎ
উৎপাদন; তৃতীয়ত, বন্যা নিয়ন্ত্রণ। এছাড়াও বিভিন্ন প্রকল্পের ফলে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন, পানের উপযোগী স্বাদু পানি সরবরাহ প্রকল্প স্থাপন এবং পর্যটন ক্ষেত্র সম্প্রসারণ। ভারতের নদীসমূহ বিভিন্ন উৎস থেকে পানির প্রবাহ লাভ করে থাকে। ১. মূল উৎস থেকে প্রাপ্ত প্রবাহ ২. বৃষ্টির পানি ৩. উপনদীর প্রবাহ ৪. ঝরনাধারার পানি এবং লোকালয় থেকে নর্দমা থেকে দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি। নিজেদের সমৃদ্ধির সোপান গড়ে তুলতে তারা নদীর পানি একস্থান থেকে অন্য স্থানে স্থানান্তরের জন্য খাল বা ক্যানাল খনন, এক নদীর সঙ্গে অপর নদীর সংযোগ সাধন, নদীর উচ্চতম স্থানে ড্যাম তৈরি ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপন, ব্যারাজ ও ব্রিজ নির্মাণ, নদীর এক বেসিন থেকে অন্য বেসিনে স্থানান্তর।
ভারত ইতোমধ্যে (২০১৫ সালের পূর্বে) দৃশ্যমান নদ-নদীগুলোর ওপর ৩৬০০ টির অধিক বাঁধ বেঁধে ফেলেছে। ২০১৫ সাল থেকে নতুন করে অতিরিক্ত ১০০০ বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু করে। উজানে ভারত তার বহুসংখ্যক সেচ ও পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য মূল গঙ্গা এবং এর আশেপাশের উপনদীগুলোর ৯০ ভাগ পানি সরিয়ে নিচ্ছে। কেবল ফারাক্কাই নয়, গঙ্গা-পদ্মাকেন্দ্রিক বাঁধ, জলাধার, ক্রসড্যাম, রেগুলেটরসহ অন্তত ৩৩টি মূল অবকাঠামো নির্মাণ করেছে। এরসঙ্গে রয়েছে আনুষঙ্গিক আরো অসংখ্য ছোটো বড় প্রকল্প। নতুন করে উত্তরাখ- রাজ্য সরকার নতুন করে ৫৩টি বিদ্যুৎ প্রকল্প পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। ভারত অনেক আগে থেকেই গঙ্গায় বৃহদাকার তিনটি খাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এরমধ্যে রয়েছে, ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, এবং ‘নিম্নগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’।’ এরূপ প্রকল্পের হাজার হাজার কিলোমিটার খালের মাধ্যমে তারা গঙ্গার পানি সরিয়ে নিয়েসেচ দেবার ব্যাপক
কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এসব ক্যানেল প্রকল্প চাঙা রাখতে নিয়মিতভাবে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ভারতের ভিতরেও গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানির উৎস বৃদ্ধির সহায়ক উপনদীগুলোতেও বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। বাংলাদেশে পানির জন্য হাহাকার থাকলেও ফারাক্কায় পানি না থাকার অজুহাতে বাংলাদেশকে পানি বঞ্চিত করা হচ্ছে। প্রকৃত বাস্তবতা হলো ভারত অনেক আগে থেকেই ভেতর থেকে বাঁধ দিয়ে নদীগুলোকে বন্ধ্যা করে রেখেছে।
ইন্ডিয়া টুডে পত্রিকার তথ্য থেকে জানা যায়, ফারাক্কা পয়েন্টে আসার আগেই উজানে উত্তর প্রদেশ ও বিহারে গঙ্গা থেকে ২৫-৪৫ হাজার কিউসেক পানি প্রত্যাহার করা হচ্ছে। ফলে ফারাক্কা পয়েন্টে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ভারত-ভুটান-নেপালের পরিকল্পনা
অনুযায়ী ৫৫২টি বাঁধকে কেন্দ্র করে সর্বমোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য হচ্ছে ২ লাখ ১২ হাজার ২৭৩ মেগাওয়াট। নির্মম বাস্তবতা হলো এই ৫৫২টি বাঁধই বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদীগুলোর উজানে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী উৎপাদিত বিদ্যুতের এক মেগাওয়াটও বাংলাদেশ পাবে না, অথচ পরিবেশ ও জীবিকার ওপর ক্ষতির সম্মুখীন হয় বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে। বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা অনুযায়ী কখনো যদি ৮ রিখটার স্কেলে কোনো ভূমিকম্প বাংলাদেশে হয়, তাহলে প্রধান প্রধান নদীগুলোর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক, আঞ্চলিক এবং দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে চাপ প্রদান অব্যাহত রাখতে হবে। নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, ভারত, চীনকে নিয়ে একটি আঞ্চলিক নদী কমিশন গঠন করতে হবে। জাতিসংঘ ঘোষিত নদী কমিশনে বাংলাদেশের স্বাক্ষর করা অতীব জরুরি। বিশ্ব ব্যাংক ঘোষিত ১৯৯১ সালে গৃহীত নীতিমালা অনুযায়ী পরিবেশের ক্ষতি হতে পারে এমন ধরনের যে কোনো প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ করার শর্ত বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংক এবং জাতিসংঘকে বাংলাদেশের এই পরিবেশগত বিপর্যয়ের ক্ষয়ক্ষতির প্রভাব সম্পর্কে অবহিত করে জাতিসংঘের মাধ্যমেই এর সমাধান করা জরুরি। বিশ্ব পরিবেশ দিবসে এই আমাদের প্রত্যাশা।
(লেখক: ড. মো. আমিরুল ইসলাম কনক, সহযোগী অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ও ভূতপূর্ব আহ্বায়ক, তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ ও বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, রাজশাহী জেলা)