• Sun. Dec 22nd, 2024

দৈনিক পাবনার আলো, মাহফুজ আলী কাদেরী কর্তৃক সম্পাদিত

#pabnaralo#, pabna# pabnanews# পাবনারআলো# পাবনার_আলো#পাবনারখবর#পাবনারবার্তা

ওঁরা কাঁদছেন- তাঁরা হাসছেন

কেমন একটা বাংলাদেশের জন্য তখনকার সাত কোটি বাঙালি হাজারো লড়াই, আন্দোলন এবং সর্বশেষে ১৯৭১ এর নয়টি মাসব্যাপী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামক এই স্বাধীন রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন-সে কথাটি যতই গুরুত্বপূর্ণ হোক-আজ তা আামরা দিব্যি ভুলতে বসেছি।এমনকি ভুলতে বসেছি বাঙালি জাতির জনক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে রচিত সর্বত্র নন্দিত বাহাত্তরের সংবিধানের চার রাষ্ট্রীয় মৌলনীতিকেও (ধর্ম নিরপেক্ষতা,গণতন্ত্র,সমাজতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ) আমরা দিব্যি খুইয়ে বসেছি। ১৯৪৮ থেকে শুরু করে ১৯৭০ এবং তারপর মার্চ, ১৯৭১ পর্যন্ত যে তীব্র গঠনতান্ত্রিক এবং ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন সমূহ যে প্রত্যাশা নিয়ে অব্যাহতভাবে চালিয়েছিলেন তা না হওয়ায় পরবর্তী নয়টি মাস সেই লাখো মানুষ অস্ত্র ধরে, যুদ্ধ করে,দেশটাকে স্বাধীন দেশের বিরল মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করে। কেউ খাবে, কেউ খাবে না- বলা চলে এটাই ছিল মানুষের স্বতঃ উচ্চারিত স্লোগান । বঙ্গবন্ধুর সেই সময়ের অমর উক্তি “আমি শোষিতের পক্ষে”, দেশের সকল অবিভক্ত, বিভক্ত বামপন্থী দলগুলির পক্ষ থেকে দেশী-বিদেশী সকল প্রকার শোষণের অবস্থান এবং শোষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠণের উচ্চারিত দাবী বাংলাদেশের সকল রাজপথকে কাঁপিয়ে তুলেছিল।
ঐ যুবসমাজের লড়াই নিয়মতান্ত্রিক থেকে সশস্ত্র যুদ্ধকালে নয় মাসব্যাপী পাক সেনা নিধনযজ্ঞ পরিচালিত হয়-সেই সাথে এ দেশীয় পাকিস্তানী দালালদেরকে ও নিধন করতে হয়েছিল,এত কিছুর পরে ১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আমরা সাত কোটি বাঙালি পেলাম আমাদের স্বপ্নের সাধের বাংলাদেশ।
যে বঙ্গবন্ধুর নামে বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ চালিয়েছিল, ৪/৫ লক্ষ বাঙালি নারী – হিন্দু,মুসলিম নির্বিশেষে সম্ভ্রম হারিয়েছিল, যে লক্ষ লক্ষ ঘর-বাড়ী লুট পাট- আগুন দিয়ে পুড়িয়ে, ছাই করে দিয়েছিল পাক বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দালালেরা, সেই স্বাধীন বাংলার ভস্মস্তুপে ফিরে এলেন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী জেল থেকে দেশ- বিদেশের সকল গণতান্ত্রিক শক্তির প্রবল চাপে।
বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারী, ১৯৭২ এসে নামলেন তাঁর প্রিয় বাংলাদেশের মাটিতে-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন পরদিনই।
দেশ- বিদেশের সকল বন্ধুরাই- বিশেষ করে ভারত (শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন) সরকার ও সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন শক্তিশালী সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ঠিক এগিয়ে এলো বঙ্গবন্ধুর ডাকে যুদ্ধ-বিধ¦স্ত বাংলাদেশ পূর্ণগঠনে। বিধ¦স্ত রাস্তাঘাট, সেতু,বিদ্যুৎ, উৎপাদন কেন্দ্র ও অন্যান্য যা কিছু জরুরী করণীয়-সেগুলি সংস্কার, পূন: নির্মাণ- প্রভৃতি করে দেশের এক অংশ থেকে অপর অংশে মানুষের চলাচল ও পরবর্তীতে ধীরে ধীরে পণ্য চলাচল শুরু করে দেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার বহুলাংশে সম্ভব হয়।
অতঃপর বঙ্গবন্ধু শ্রমিক ও কৃষককে শোষণমুক্ত করার কাজ হাত দেন। তাঁর নিজস্ব চিন্তা-চেতনা অনুযায়ী তিনি ধনীর রাজত্ব খর্ব করার উদ্দেশ্যে দেশের সকল কল-কারখানা জাতীয়করণ করেন, জমির সিলিং নির্ধারণ করেন ৩০ বিঘা (করে নিজের দলের নেতাদের চাপে পড়ে পরে জমির সিলিং ১০০ বিঘায় উন্নীত করেন)। দেশে ঘুষখোর – দুর্নীতিবাজেরা তাদের কর্মকা- চালানো থেকে বিরত হয়।
কিন্তু পাকিস্তানি আমলে শক্তিশালী হয়ে গড়ে ওঠা মুষ্টিমেয় ধনিক – বনিক এই পরিস্থিতি মেনে নিতে কিছুতেই রাজি হয় নি। তারা দেশের অভ্যন্তরে মোশতাক জিয়া এবং বিদেশে মার্কিন সা¤্রাজ্যবাদের সাথে গোপন শলা পরামর্শ চালাতে থাকে এবং তারই ফলশ্রুতিতে ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ এর ভয়াবহ হত্যালীলার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে বাংলাদেশের রাষ্টক্ষমতা দখল করে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপরীত মুখী ভূমিকা নিয়ে পাকিস্তানী ধারা পুনঃপ্রচলনে সচেষ্ট হয়। একদিকে বঙ্গবন্ধুকে ইসলাম বিরোধী বলে মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগকে ,বৈধতা প্রদান,পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরন, সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’্ সংযোজন এবং সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা উধাও করার কাজে হাত দেয়।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক জাতীয় করনকৃত সকল কলকারখানা বিক্রীর নামে পুনরায় পুরাতন মালিকদের কাছে জলের দামে হস্তান্তর করে। ফলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক সরকারী কর্মচারী থেকে রাতের অন্ধকারে বেসরকারী কর্মচারীতে পরিণতই হলো না – মালিকরা ঐ শ্রমিকদেরকে ছাঁটাই কারায় তারা মারাত্বক বেকারত্তের কবলে পড়ে অসহায়ত্বের শিকারে, পরিণত হলেন।
সিলিং তুলে দেওয়াতে বড় বড় জমির মালিক তৈরী হলো – তারা খেত মজুর – দিন মজুরদের মজুরী মারাত্মকভাবে কমিয়ে দেয়-খেত মজুর দিন মজুররা সংখ্যায় বিপুল হলেও তারা বছরে কমপক্ষে ৪/৫ মাস কোনো কাজ না পেয়ে চরম বেকারত্বের কবলে পড়লেন। সেই বেকারের সংখ্যা দিনে দিনে আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে। অপরদিকে সরকারী আমলে বেসরকারী ধনিক বনিকেরা উন্নয়নের সাথে কৃষিজমি অধিগ্রহন করে, দালান কোঠা তুলছেন, অফিস- আদালত, রেলপথ নির্মান করছেন। ফলে দিনে দিনে কৃষিজমি হ্রাস পাওয়ায় কৃষিক্ষেত্রে সংকট বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অপরদিকে সরকারি- বেসরকারী উদ্যোগে করকারখানা গড়ে না ওঠার ফলে শ্রমিকদের বেকারত্ব সমাধান অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রেও গার্মেন্টস, ঔষধ এবং প্রবাসে চাকুরিই হলো প্রধান বিদেশী মুদ্রা উপার্জনের মাধ্যম। এ ছাড়া ইউক্রেন যুদ্ধ এক নতুন আপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং ধনিক বনিকদের গরীব শোষণের নতুন মুখোশ করে দিযেছে।
এই সকল কারণের মাঝে মওজুতদায়ী কালোবাজারী যুক্ত হয়ে, হু হু করে সকল প্রকার পণ্য বিশেষ করে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য মুল্য- বেড়ে যাওয়ায় কোটি কোটি মানুষের জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠেছে।
এ বারে ফিরে তাকানো যাক মুক্তিযুদ্ধ ও তার অঙ্গীকারের দিকে। যে দেড় দুই লক্ষ তরুণ তরুনী হাতে অস্ত্র নিয়ে একাত্তরের নয় মাস লড়াই করে, দেশস্বাধীন করলেন- তাঁরা দু’ চার জন বাদে,সবাই দরিদ্র ঘরের বিশেষ করে শ্রমিক – কৃষক ও নি¤œবিত্ত ঘরের সন্তান। যে ত্রিশ লক্ষ মানুষ শহিদ হলেন,যে বুদ্ধিজীবীরা নিহত ও শহিদ হলেন। যে লক্ষ লক্ষ বাড়ীঘর লুট পাট ও অগ্নিদগ্ধ হলো তার মালিকেরা ছিলেন দরিদ্র। তাঁদের কে শোষণমুক্ত করার অঙ্গিকার ছিলো বঙ্গবন্ধুর ও সচরাচর নেতৃত্বের পক্ষ থেকে সুস্পষ্টভাবে একই অঙ্গীকার দিয়ে সকল আন্দোলন সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল- সাত কোটি বাঙালির ক্ষেত্রে ও একই কথা প্রযোজ্য। সেই দরিদ্র মানুষ এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্ম আজ নিজ দেশে পণ্য মূল্য বৃদ্ধির,অসহায় শিকার। তাদের ঘরে জন্ম নেওয়া শিশুরা বাধ্য হচ্ছে অপুষ্টিতে ভুগতে। অর্থনীতির যে পুঁজিবাদীকরণ মোশতাক- জিয়া-এরশাদ-খালেদারা শুরু করলেন-আজ তা ফুলে ফলে বিকশিত। পাকিস্তানের হাতে পরিবার কোটিপতির স্থলে আজ হাজার হাজার কোটিপতি জন্ম নিয়েছে। দূর্নীতি সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছে। রাষ্ট্রযন্ত্রে তারা দিব্যি ঠাঁই করে নিয়েছে। তারাই আবার অসংখ্য সিন্ডিকেট গড়ে তুলে বাজারে, আগুন ধরাচ্ছে। সরকার যেন অসহায় ঐ ধনিক শ্রেণির কাছে, কারণ রাষ্ট্রের সব কয়টা যন্ত্রই ধনিক শ্রেণির দখলে চলে গেছে। তারাই এম,পি, মেয়র, চেয়ারম্যান নির্বাচনে সরকার দলীয় মনোনয়ন পায়- কোটি কোটি টাকা খরচ করে,অবৈধভাবে হলেও ,নির্বাচিত হয়। আর লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে এই ‘নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা’ কেমন বাড়ী গাড়ীর মালিক হয়েছেন, কেমন অঢেল সম্পদ লাখে-বেলাখে গড়ে তুলেছেন দেশে ও বিদেশে। গোটা উন্নয়নের তারাই হলেন বেনিফিশিয়ারি। তাদের সন্তানেরা -বিদেশে পড়তে যায়-গরীবদের সন্তানেরা গ্রামে-গঞ্জে কুলিগিরি করে-হাটে বাজারে ঘুরে বেড়ায়। শিক্ষা বিনা পয়সায় এবং বই কিনে পয়সায় দিলেও পেটের ভাতেঁর নিরাপত্তা না থাকায় তারা স্কুল গামী হয় না-গেলেও কিছুদিনের মধ্যে ঝরে পড়ে।
পুঁজিবাদ বাংলাদেশকে গ্রাস করায় একদিকে কোটি গরিব কাদঁছে- অপরদিকে মুষ্টিমেয় ধনিক- বনিকের ঘরে হাসির ফোয়ারা ছুটছে। এর অবসান ঘটাতে চাই আর একটা মুক্তিযুদ্ধে।

(লেখক: রণেশ মৈত্র (সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *