পাবনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে টাউন গার্লস হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক রবিউল করিম ফিরোজের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন হয়রানী ও বিদ্যালয়ের অর্থ লুটপাট, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অভিযোগ উঠেছে।
মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) দুপুর ১ টার দিকে দূর্নীতিবাজ- চরিত্রহীন এ প্রধান শিক্ষকের অপসারণ ও পদত্যাগের একদফা দাবিতে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। এর আগে গত (মঙ্গলবার ১০ সেপ্টেম্বর) থেকে ক্লাস বর্জন করে লাগাতার কর্মসূচি পালন করে আসছে। জেলা প্রশাসক বরাবর একটি স্মারকলিপিও দিয়েছে তারা।
অভিযোগ সূত্রে জানা গেছে, অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক ফিরোজ পাবনা সদরের দুবলিয়া ফজিলাতুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। সেখানে ছাত্রীদের যৌন হয়রানির অভিযোগে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়। এরপর অর্থের বিনিময়ে শহরের সেলিম নাজির উচ্চবিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন। এই দুই বিদ্যালয়ে অনেক নাটকীয়তার জন্ম দিয়ে সেখান থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে ২০১১ সালের ১৩ আগষ্ট টাউন গার্লস হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক পদে যোগদান করেন।
বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই দফায় দফায় তার বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌনহয়রানী ও নারী কেলেংকারীর অভিযোগ উঠে। তার অনৈতিক কর্মকান্ড শহরব্যাপী মুখরোচক আলোচনার জন্ম দেয়। একাধিকবার স্থানীয় ও জাতীয় পত্রিকার শিরোনাম হন এই প্রধান শিক্ষক। বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গভর্ণিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির নীতিমালা অমান্য করে নিজের ইচ্ছামত পকেট কমিটি গঠন করে নিয়োগ বানিজ্য ও বিদ্যালয়ের অর্থ লোপাট করেন। বিদ্যালয়ের নিজস্ব জায়গায় গড়ে তোলা ৮টি দোকান ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে আদায়কৃত প্রায় ৫০ হাজার আত্মসাৎ করে যাচ্ছেন। এই অর্থের কোন হিসাব স্কুলের অন্যান্য শিক্ষকরা জানেন না। বিদ্যালয়ের আয় ব্যয়ের খাতাও হালফিল করেন না। যা পান আত্মসাত করেন। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টি মন্ত্রনালয়ের অডিট হয়। তখন প্রধান শিক্ষক রবিউল করিম ফিরোজ অডিট আপত্তি নিষ্পত্তির কথা বলে সকল শিক্ষক ও কর্মচারীর ১ মাসের (এমপিও) বেতনের প্রায় ২লাখ ৫০ হাজার টাকা তুলে পকেটস্থ করেন। প্রধান শিক্ষক এই বিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে অদ্যাবধি উপবৃত্তি সংক্রান্ত শিক্ষকদের নামে বরাদ্দকৃত টিউশন ফি প্রদান না করে আত্মসাৎ করে চলেছেন। বিদ্যালয়ের বিভিন্ন খাতে আদায়কৃত অর্থ কমিটির সাথে ভাগবাটোয়ারা করে নেন।
বিগত ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারী ম্যানেজিং কমিটির সভায় উক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ৩য় ও ৪র্থ শ্রেনির কর্মচারীরা পৃথক পৃথক ভাবে ৬টি লিখিত অভিযোগ করেন এবং তাদের লিখিত অভিযোগ ছাড়াও ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হয়ে অভিযোগের মর্মকথা ম্যানেজিং কমিটির সদস্য আলহাজ্ব আব্দুল হামিদ মাস্টার ও মিসেস রোখসানা খানমের কাছে খোলামেলা কথা বলেন।
তারা অভিযোগ করেন, প্রধান শিক্ষক বিনা পয়সায় প্রাইভেট পড়ানোর অযুহাতে ছাত্রীদেরকে কোন কোন সময় বাসায়, কোন কোন সময় অফিস কক্ষে ডেকে নিয়ে শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে, অর্থের বিনিময়ে কোন মেয়েকে সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে এবং তার কুপ্রস্তাবে কোন শিক্ষার্থী সম্মত না হলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালি দেওয়াসহ প্রভৃতি আশালীন ও অনৈতিক কাজ করে।
সভায় উপস্থিত সদস্যরা বলেন, প্রধান শিক্ষকের এরুপ অনৈতিক কর্মকান্ডের ফলে বিদ্যালয় পরিচালনায় স্বাভাবিক কার্যক্রম বিঘ্ন ঘটছে, অনেক শিক্ষার্থী ছাড়পত্র (টিসি) নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে, ফলে বিদ্যালয়টি অধঃপতনের দ্বারপ্রান্ত উপনীত হচ্ছে।
এই সভায় প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধ আনিত সকল অভিযোগ প্রাথমিক তদন্ত সাপেক্ষে প্রমানিত হওয়ায় প্রধান শিক্ষক রবিউল করিমকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়।
অভিযোগ বিষয়ে তদন্ত করার জন্য জেলা শিক্ষা অফিসারকে প্রধান করে তার মনোনীত অপর ২জন সদস্যসহ ৩ জন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এবং তার মনগড়া কমিটিকে অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগের তদন্ত কাজে বাধা সৃষ্টি করায় অদ্যাবধি আলোর মুখ দেখেনি। অভিযোগ রয়েছে ধুরন্ধর প্রধান শিক্ষক রাতের আঁধারে কমিটির সদস্যদের হাতে পায়ে ধরে মোটা অংকের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ধামাচাপা দিয়ে স্বপদে পুর্ণবহাল হয়ে পূর্বের চেয়ে ভয়ঙ্কর রূপে ফিরে আসেন।
বিদ্যালয়ের শিক্ষক সহ অফিস স্টাফদের সাথে তুচ্ছ বিষয়ে দুর্ব্যবহার করেন। ইতিপূর্বে তিনি তুচ্ছ বিষয় নিয়ে নৈশ প্রহরী বাচ্চুর মাথায় তালা দিয়ে আঘাত করে মাথা ফাটিয়ে দেন। এ বিষয়ে বাচ্চু মামলা করলে তাকে তার পোষা পেটোয়া বাহিনী দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে মামলা তুলে নিতে বাধ্য করেন এবং তার (বাচ্চু) ১ মাসের বেতন কর্তন করে দেন।
অফিস সহকারী রানা আহমেদের সাথে প্রায়ই তুচ্ছ বিষয়ে ঝগড়াঝাটি ও গালমন্দ করে শারীরিক ও মানুষিকভাবে নির্যাতন করতো এই বদমেজাজী প্রধান শিক্ষক। এক পর্যায়ে তাকে চাকুরী ছাড়তে বাধ্য করেন এবং এই পদে প্রধান শিক্ষক তার চাচাতো ভাই আবুল বাশার সোনাইকে ৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেন।
অবৈধ কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে তিনি ল্যাব অপারেটর পদে ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে নুরুজ্জামানকে এবং নৈশ প্রহরী (নাইট গার্ড) পদে ৬ লাখ টাকার বিনিময়ে বাদশা মিয়াকে নিয়োগ দেন।
এমনকি ২০২৩ সালে এনটিআরসিএ কর্তৃক ৩ জন শিক্ষক নিয়োগ সুপারিশপ্রাপ্ত হয়ে এলে তাদের নিয়োগপত্র প্রদানে নানা অজুহাতে গড়িমসি করেন এবং বিদ্যালয়ের উন্নয়নের জন্য টাকা দাবি করেন। তিনি বিদ্যালয়ের উন্নয়ন ফি, সেশন ফি ও ফরম পুরনের সময় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন। ৮ম ও ৯ম শ্রেণির রেজিষ্ট্রেশন ফি ৫০০ টাকা এবং প্রশংসাপত্রের জন্য ৫শ টাকা আদায় করেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ন্যায্য পাওয়া টিউশন ফি এবং বিদাালয় হতে শিক্ষকদের বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও তাও দেন না। বিদ্যালয়ের পুরাতন বই, কাগজপত্র ও অব্যবহৃত আসবাপত্র রাতের আঁধারে বিক্রি করে দেন এবং নৈশপ্রহরীর উপর বারবার দোষ চাপিয়ে দেন। গত ৩০/০৮/২০২৪ ইং তারিখে প্রধান শিক্ষক গভীর রাতে বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র হস্তগত করতে চেষ্টা করেন।
এসময় আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে গেলে তিনি অতি জরুরি কাজে এসেছেন বলে জানান।
বিদ্যালয়ের নৈশ প্রহরী অভিযোগ করে বলেন, প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয়ের অফিসকক্ষে বহিরাগতদের সঙ্গে মধ্যরাতে পদ্যপান করেন। বিভিন্ন ছাত্রছাত্রী, অভিভাবকদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন।
এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জাহানারা রাইসা লিজা বলেন, আমি ২০১৬ সালে যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে ছিলাম তখন আমার ক্লাসের ১নং রোল মুসলিমার (কাঁচারীপাড়া কদমতলা বাড়ি) সাথে এই স্যার খুব খারাপ কাজ করে। মেয়েটি স্কুল ছেড়ে চলে যায়। হেড স্যার লোক মারফত মুসলিমার পরিবারকে চাপ দিয়ে অল্প বয়সেই তাকে বিয়ে দিতে বাধ্য করে।
শিক্ষার্থী লোদী সুমাইয়া, রোমানা রুহি বলেন, এই স্যার অনেক মেয়ের সাথেই খারাপ কাজ করেছে। অনেক মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে। ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভয়ভীতি দেখিয়ে খারাপ কাজ করার পরও তার পক্ষে লিখিত স্বাক্ষ্য দিতে বাধ্য করেছে।
আরেক শিক্ষার্থী সুমাইয়া আফরিন রিমি বলেন, আমার জানামতে বর্ননার চাইতেও বেশি খারাপ কাজ করেছে এই বজ্জাত স্যার । তার চাইতে বড় লুচ্চা মনে হয়না আর কোথায়ও আছে। আমরা তার দ্রুত পদত্যাগ ও শাস্তির দাবি জানাই।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, সাথী নামের এক শিক্ষার্থীর সাথে খারাপ কিছু করার পর ঐ ছাত্রীর ব্যাগে কনডম আছে বলে সকল শিক্ষকের সামনে তার ব্যাগ চেক করতে বলেন প্রধান শিক্ষক। মেয়েটি কান্না করে ঐ দিনেই বিদ্যালয় ত্যাগ করেন।
বিদ্যালয়ের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী মেঘা জানান, এ বছরে সে এ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কিছুদিন পর তাকে কোলে তুলে শরীর স্পর্শ করেন ও মোবাইলে খারাপ ভিডিও দেখান প্রধান শিক্ষক। ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী তানিয়া, রোজসহ দশম শ্রেণির একাধিক শিক্ষার্থী তাদের শরীর স্পর্শ, অশালীন কথাবার্তা ও অশ্লীল ইঙ্গিতের অভিযোগ করেন প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
পাবনা জেলা শিক্ষা অফিসার রোস্তম আলী হেলালী বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসক স্যারকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
পাবনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মাহফুজা সুলতানা বলেন, আমরা ইতোমধ্যে লিখিতভাবে অভিযোগ পেয়েছি। আমাদের ডিসি স্যার অতিরিক্ত জেলা মেজিষ্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল মামুন স্যারকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। তদন্তে প্রমাণিত হলে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।