(পূর্ব প্রকাশের পর) কিন্তু সালাহউদ্দিন তার সেনাদের সরিয়ে নেন এবং গাজার দিকেই এগিয়ে যান। তিনি গাজায় প্রবেশ করে নাইট টেম্পলারদের জন্য খৃস্টান রাজা তৃতীয় বল্ডউইন কর্তৃক নির্মিত প্রাসাদ গুঁড়িয়ে দেন। সে বছরের ঠিক কবে এলিয়াতের ক্রুসেডার দুর্গ তিনি জয় করে নেন সেটা স্পষ্ট নয়। এটি আকাবা উপসাগরের একটি দ্বীপের উপর অবস্থিত ছিল। এটি মুসলিম নৌবাহিনীর যাতায়াতের জন্য হুমকি ছিল না। কিন্তু ক্ষুদ্র মুসলিম নৌবহরকে তা ব্যতিব্যস্ত রাখে বিধায় সালাহউদ্দিন এটি দখল করে নেন।
মিশর ও সিরিয়ার সুলতান সালাহউদ্দিন ১১৭১ সালের জুন মাসে নুরুদ্দিন জেনগি সালাহউদ্দিনকে মিশরে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলে চিঠি লেখেন। এ সময় কয়েকজন মিশরীয় আমির অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে নিহত হন। ফাতেমী খলিফা আল আদিদকে বলা হয় যে, তাদেরকে বিদ্রোহের কারণে হত্যা করা হয়েছে। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড´েন। একটি সূত্র মতে তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়। অসুস্থ অবস্থায় তিনি তার সাথে দেখা করার জন্য সালাহউদ্দিনকে খবর পাঠান যেন তার সন্তানদের ঠিকমতো দেখাশোনা করা হয়। সালাহউদ্দিন আব্বাসীয়দের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কায় তার সাথে দেখা করতে যাননি। কিন্তু আল আদিদ কী বলতে চেয়েছিলেন তা জানার পর তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। পাঁচদিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর আল আদিদ মৃত্যুবরণ করেন। কায়রো ও ফুসতাতে আব্বাসীয় খলিফার নামে খুতবা পাঠ করা হয় এবং আব্বাসী খলিফা আল মুসতাদিকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সালাহউদ্দিন জেরুজালেম রাজ্যের মরু দুর্গ ক্রাক ও মন্ট্রিয়ালের উদ্দেশ্যে কায়রো ত্যাগ করেন। সিরিয়ার দিক থেকে এ সময় নুরুদ্দিন জেনগিও আক্রমণ চালান। তবে মন্ট্রিয়াল পৌঁছার পূর্বেই মিশরের বিদ্রোহের খবর শুনে সালাহউদ্দিন কায়রোতে ফিরে আসেন। এর ফলে নুরুদ্দিন একাই সেখানে লড়তে থাকেন। ১১৭৪ সালের মার্চে একটি ভূমিকম্পের পর বাগদাদে ফিরে আসেন নুরুদ্দিন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যখন তিনি বিশাল এক বাহিনী প্রস্তুত করছিলেন ঠিক তখনই তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়। ১১৭৪ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে বিষপ্রয়োগের ফলে নুরুদ্দিন জেনগি ১১৭৪ সালের ১৫ মে মৃত্যুবরণ করেন। সিরিয়ার অভিজাত জেনগিরা নুরুদ্দিনের এগারো বছর বয়সী নাবালক পুত্র আস সালিহ ইসমাইল আল মালিককে সিংহাসনে বসায়। নুরুদ্দিনের মৃত্যুর ফলে সালাহউদ্দিন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তার সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র ও গুরুকে হারিয়ে ফেলেন। নুরুদ্দিনের পুত্র সালিহর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি জানান যে, আপনি ও আপনার সমর্থকরা
নুরুদ্দিনের নীতির অনুসরণ করলে এবং ক্রুসেডারদের সাথে মিত্রতা থেকে বিরত থাকলে সালাহউদ্দিন আপনার কাছে মাথা পেতে দিবে। কিন্তু নুরুদ্দিনের নাবালক পুত্র শাসক সালিহকে ঘিরে ক্রুসেডাররা নানা যড়যন্ত্র শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন সালাহউদ্দিন। সিরিয়া ও আলেপ্পোতে জেনগিদের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর সালাহউদ্দিন নিজেকে ওই অঞ্চলের শাসক ঘোষণা করেন। সালিহর নাম জুমার খুতবা ও মুদ্রা থেকে বাদ দেয়া হয়। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা সালাহউদ্দিনের ক্ষমতাপ্রাপ্তিকে স্বাগত জানান এবং তাকে মিশর ও সিরিয়ার সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন।
আপনি ও আপনার সমর্থকরা নুরুদ্দিনের নীতির অনুসরণ করলে এবং ক্রুসেডারদের সাথে মিত্রতা থেকে বিরত থাকলে সালাহউদ্দিন আপনার কাছে মাথা পেতে দিবে।
নুরুদ্দিন জেনগির পুত্র সালিহকে লেখা চিঠিতে সালাহউদ্দিন
লক্ষ্য বাইতুল মোকাদ্দাস
মুসলিম সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ কোন্দল আর আর ক্রুসেডারদের একের পর এক আক্রমণ স্বত্বেও লক্ষ্য থেকে মোটেও দূরে সরে যাননি সালাহউদ্দিন। বাইতুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ছক আঁকছিলেন এই বীর সেনাপতি। সুলতান সালাহউদ্দিন কায়রো ফিরে এসে এখানে তলোয়ার প্রস্তুতকারকদের কারখানা স্থাপন করেন এবং এখান থেকেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা শুরু করেন। ১১৭৭ সালের নভেম্বরে তিনি ফিলিস্তিনে আক্রমণ পরিচালনা করেন। এ সময় সালাহউদ্দিনের গোয়েন্দারা তাকে জানায় যে, ক্রুসেডাররা সিরিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। তিনি তার সেনাপতি ফররুখশাহকে তার এক হাজার সেনা নিয়ে
দামেস্কের সীমানায় পাহারা দেয়ার নির্দেশ দেন। ১১৭৯ সালের এপ্রিলে খৃস্টান রাজা বল্ডউইনের নেতৃত্বাধীন ক্রুসেডাররা কোনো প্রতিরোধ হবে না ধরে নিয়ে সিরিয়ার গোলান মালভূমির পূর্বে মুসলিম পশুপালকদের উপর আচমকা হামলা হয়। ফররুখশাহর বাহিনীর উদ্দেশ্যে বল্ডউইন খুব দ্রুত যাত্রা করেন। কিন্তু ওঁত পেতে ছিলো ফররুখশাহের দল। তাদের মধ্যে সংঘটিত লড়াইয়ে আইয়ুবী বাহিনী জয়ী হয়। এ বিজয়ের পর সালাহউদ্দিন মিশর থেকে আরো সেনা আনার পরিকল্পনা করেন। এরপর একের পর এক যুদ্ধে খৃস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করতে থাকেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।
১১৮৭ সালের জুলাই মাসে সালাহউদ্দিন ক্রুসেডারদের কিংডম অফ জেরুজালেম বা জেরুজালেম রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেন। ১১৮৭ সালের ৪ জুলাই হাত্তিনের যুদ্ধে জেরুজালেমের রাজা গাই অব লুসিগনান ও তৃতীয় রোনাল্ডের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে সালাহউদ্দিনের বাহিনী মুখোমুখি হয়। যুদ্ধে ক্রুসেডার সেনাবাহিনী প্রায় সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ক্রুসেডারদের জন্য এটি একটি ভয়াবহ বিপর্যয় ছিল এবং ক্রুসেডের ইতিহাসে এটি গতি নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। রোনাল্ড অব শাটিলনকে বন্দী করা হয়। বেসামরিক মুসলিম ও হজযাত্রীদের উপর আক্রমণের কারণে সালাহউদ্দিন নিজে তাকে হত্যা করেন। বলা হয়ে থাকে, ইসলাম গ্রহণ করে তাকে তওবার সুযোগ দেন সুলতান। কিন্তু রোনাল্ড বলেন, একজন রাখালের ধর্ম গ্রহণ করা আমার মতো রাজার শোভা পায় না। রাসুল (স)-এর প্রতি অবজ্ঞা করে কথা বলায় ক্ষিপ্ত সালাহউদ্দিন তৎক্ষণাৎ তাকে হত্যা করেন। তার সাথে গাই অব লুসিগনানকেও বন্দী করা
হয়। রোনাল্ডের পরিণতি দেখে তিনি আতঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে হয়তো তাকেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। তবে সালাহউদ্দিন তাকে ক্ষমা করে দেন এবং বলেন যে, এক রাজা অন্য রাজাকে কখনও হত্যা করে না, কিন্তু ওই লোকটা সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বিধায় আমি এমন আচরণ করেছি।
জেরুজালেম অবরোধ ও জয়
১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর শুক্রবার সালাহউদ্দিনের সেনাবাহিনী দীর্ঘ অবরোধের পর ক্রুসেডারদের হাত থেকে জেরুজালেম জয় করেন। প্রায় ৮৮ বছর আগে যখন খৃস্টান টেম্পলাররা মুসলিমদের পরাজিত করে জেরুজালেম দখল করে নেয়, তখন গণহারে মুসলিমদের হত্যার করে। বলা হয়ে থাকে, মুসলিমদের রক্তে জেরুজালেমের রাজপথে প্রায় হাটুর সমান রক্ত প্রবাহিত হয়। অথচ সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী চলি´শ দিন সময় দেন মুক্তিপণ দিয়ে নিরাপদে শহর ছেড়ে চলে যেতে। শহরের প্রত্যেক নারী, পুরুষ বা শিশুর জন্য সেসময়ে অনেক কম মুক্তিপণ ধার্য করা হয় (আধুনিক হিসাবে ৫০ ডলার)। অনেক পরিবার যারা মুক্তিপণ দিতে সক্ষম ছিল না তাদেরকেও তিনি মুক্তি দেন। জেরুজালেমের পেট্রিয়ার্ক হেরাক্লিয়াস বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেন যার মাধ্যমে ১৮,০০০ গরিব নাগরিকের মুক্তিপণ আদায় করা হয়। জেরুজালেম বিজয়ের পর সালাহউদ্দিন ইহুদিদের শহরে পুনরায় বসবাসের অনুমতি দেন। আসকালনের ইহুদি সম্প্রদায় তার এই ডাকে সাড়া দেয়। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষের উপর সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া সেনাপতি শত্রুদের প্রতিও ছিলেন অত্যন্ত উদার। যুদ্ধের ময়দানে জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়া খৃস্টান রাজা রিচার্ডের জন্য পাঠিয়েছিলেন নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। এভাবেই জয় করেছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা দ্য লায়ন হার্ট খ্যাত রিচার্ডের মন। ফলে সন্ধি করে ফিরে গিয়েছিলেন রিচার্ড।
এরপর প্রায় ৮০০ বছর বাইতুল মোকাদ্দাস মুসলিমদের অধীনেই ছিলো। শত আক্রমণ আর চক্রান্তের পরও পবিত্র এই শহরের দখল নিতে পারেনি ক্রুসেডাররা। সর্বশেষ উসমানী খলিফা সুলতান আব্দুল হামিদের নিকটও অনেক লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিলো ক্রুসেডাররা। কিন্তু তিনি সব প্রস্তাব ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেন, যতক্ষণ তার দেহে প্রাণ আছে তিনি মুসলিম উম্মাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানী খেলাফত দূর্বল হয় পড়লে বৃটিশদের সহায়তায় আরব রাজ্যগুলো একের পর এক বিদ্রোহ শুরু করে। নিজেদের স্বাধীন আমির ঘোষণা দিয়ে তারা ফিলিস্তিন অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৃটিশ দাবি মেনে নেয়। ফলে ফিলিস্তিনিদের জমি জবর-দখল করে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৬৭ সালে যারা বাইতুল মোকাদ্দাসের নিয়ন্ত্রণও গ্রহণ করে। আজও ফিলিস্তিনের আল-আকসা মসজিদ জায়োনিস্ট ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। কিছুদিন পরপরই নিরস্ত্র ও নামাজরত মুসলি´দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার দল। অবশ্য পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ফিলিস্তিনিরাও। পবিত্র বাইতুল মোকাদ্দাস ও ইসলামের প্রথম কেবলা পুনরুদ্ধারে এখনও সেখানে লড়াই বিদ্যমান।