মুসলিম উম্মাহর জন্য সময়টা ছিলো অত্যন্ত নাজুক যখন সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম হয়। একদিকে মুসলিম শাসকদের বিলাসিতা আর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বিভিন্ন অঞ্চলের আমিররা নিজেদের স্বাধীন রাজা হিসেবে ঘোষণা দিচ্ছে। ফলে মুসলিম খেলাফতের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলে তেমন কিছু ছিলো না। অপরদিকে পোপের আহ্বানে সঙ্ঘবদ্ধ খৃস্টান ক্রুডেরদের বিশাল বাহিনীর আক্রমণ। যারা ইতিহাসে নাইট টেম্পলার যোদ্ধা হিসেবেও পরিচিত। ইতিমধ্যেই সম্মিলিত ক্রুসেডার বাহিনী সফলভাবে মুসলিমদের প্রথম কেবলা বায়তুল মুকাদ্দাস দখল করে নিয়েছে। শিগগিরই গোটা মুসলিম সাম্রাজ্য দখলের পাঁয়তারা করছিলো ক্রুসেডাররা। পৃথিবী থেকে ইসলামের নাম-নিশানা মুছে দেয়ার জন্য যখন ক্রুসেডাররা প্রস্তুত। ঠিক তখনই জন্মগ্রহণ করেন ইতিহাসের গতিপথ পরিবর্তনকারী সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী- যিনি ক্রুসেডার বাহিনীর সম্মিলিত শক্তিকে পরাজিত করে বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধার করেন। কেবল বায়তুল মুকাদ্দাস পুনরুদ্ধারই নয়, ইউরোপ থেকে ট্যাক্সও আদায় করেছিলেন এই বীর সেনানী। ফলে ইউরোপিয়ানরাও তাকে ডাকতো ‘দ্য গ্রেট সালাদিন’ নামে। হলিউডের বিখ্যাত পরিচালক ‘দ্য কিংডম অফ হেভেন’ চলচ্চিত্রও নির্মাণ করেছিলেন তার জীবনী নিয়ে। চলুন জেনে নেয়া যাক মুসলিম ইতিহাসের সোনালী সেই অধ্যায় সম্পর্কে।
সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার আসল নাম ছিলো আবু নাসির সালাহউদ্দিন ইউসুফ ইবনে আইয়ুব। তিনি ১১৩৭ সালে জন্মগ্রহণ করেন বর্তমান ইরাকের তিকরিত অঞ্চলে। তিনি ছিলেন কুর্দি জনগোষ্ঠির একজন। সালাহউদ্দিনের জন্মের প্রায় ৩৮ বছর আগে ক্রুসেডাররা বাইতুল মোকাদ্দাস দখল করে দেয়। শক্তিশালী ক্রুসেডারদের হাত থেকে ইসলামের প্রথম কেবলা উদ্ধারের বদলে মুসলিম শাসকরা নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতেই ব্যস্ত ছিলো তখন। তবে সম্মিলিত মুসলিম জনতার প্রাণের দাবি ছিলো, যেকোনো মূল্যে বাইতুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধার। সাধারণ মানুষ তাদের সন্তানদের গড়ে তুলতেন ইসলামের প্রথম কেবলা উদ্ধারের উৎসাহ দিয়ে। ছোট বেলায় বাবার সাথে মসজিদে যাওয়ার সময় একদিন তিনি দেখতে পেলেন ইরাকের একজন বিখ্যাত কাঠমিস্ত্রি খুব সুন্দর কারুকাজ করে একটি মিম্বার বানিয়েছেন। কেউ কেউ উচ্চমূল্যে সেটা ক্রয় করতে আসলেও তিনি প্রত্যাখ্যান করে বলে দিচ্ছেন, এটা তিনি বাইতুল মোকাদ্দাস মসজিদের জন্য বানিয়েছেন। মানুষজন তার এই আশার কথা শুনে হাস্যরস করছিলো যে, সমুদ্রের মতো বিশাল ক্রুসেডার বাহিনীকে পরাজিত করে কে তোমার এই মিম্বার বাইতুল মোকাদ্দাসে নিয়ে যাবে? শিশু সালাহউদ্দিন ভগ্ন হৃদয়ের সেই কাঠমিস্ত্রির কাছে গিয়ে বলেছিলেন, আল্লাহর ইচ্ছায় আমি আপনার আশা পূর্ণ করবো এবং আপনার বানানো মিম্বার বাইতুল মোকাদ্দাস মসজিদে স্থাপন করবো। তিনি সত্যি সত্যিই সেই মিম্বার একদিন বাইতুল মোকাদ্দাসে স্থাপন করে নিজের ওয়াদা পূর্ণ করেছিলেন।
আল্লাহর ইচ্ছায় আমি আপনার আশা পূর্ণ করবো এবং আপনার বানানো মিম্বার বাইতুল মোকাদ্দাস মসজিদে স্থাপন করবো।
শিশু সালাহউদ্দিন আইয়ুবী তিনি সেলজুক সুলতান আল্প আরসালান ও মালিকশাহের উজির নিজামুল মুলক প্রতিষ্ঠিত সামরিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন ও প্রশিক্ষণ নেন। এছাড়া তার উস্তাদ ও ক্রুসেডারদের ত্রাস খ্যাত নুরুদ্দীন জেনগির তত্ত্বাবধানে তিনি সামরিক কলাকৌশল ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। নুরুদ্দীন জেনগি ছিলেন সিরিয়ার শাসক যিনি দ্বিতীয় ক্রুসেডে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার কৌশলের কাছে ক্রুসেডারদের বারবার পরাজয় হয়। পারিবারিকভাবে আগে থেকেই ঘনিষ্ট হওয়ায় সালাহউদ্দিনের সামরিক দক্ষতা এই বীর সেনাপতির নজর এড়ায়নি। সালাহউদ্দিনকে গড়ে তোলার দায়িত্বটা ঠিকঠাক সামলেছেন ইতিহাসের এই বীর সেনানী।
সালাহউদ্দিনের সামরিক দক্ষতা চাচা আসাদউদ্দিন শেরকুহ’র তত্ত্বাবধানে সালাহউদ্দিনের সামরিক জীবন শুরু হয়। শেরকুহ ছিলেন সিরিয়া অর্থাৎ দামেস্ক ও আলেপ্পোর আমির নুরুদ্দিন জেনগির একজন গুরুত্বপূর্ণ সামরিক কমান্ডার। নুরুদ্দীন জেনগির নির্দেশে মাত্র ২৬ বছর বয়সে সালাহউদ্দিন প্রথম অভিযানে নামেন ফাতেমী খলিফা আল-আদিদের সাহায্যে। এরপর সেখানে ক্রুসেডারদের সাথে মিশরীয় বাহিনীর লড়াই শুরু হয়ে গেলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। ক্রুসেডার বাহিনী এবং শিরকুহ’র নেতৃত্বাধীন বাহিনী গাজার পশ্চিমে নীল নদের কাছে মরু প্রান্তরে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সালাহউদ্দিন জেনগি সেনাবাহিনীর দক্ষিণভাগের নেতৃত্ব দেন। কুর্দিদের একটি দল এ সময় বাম পাশের দায´িত্বে ছিল। শিরকুহ ছিলেন মধ্য ভাগে। প্রথমদিকে ক্রুসেডাররা সাফল্য লাভ করলেও অঞ্চলটি তাদের ঘোড´ার জন্য উপযুক্ত ছিল না। বলা হয়ে থাকে, সালাহউদ্দিনের পরামর্শে শুরুতে মুসলিম বাহিনী পরাজয়ের অভিনয় করে পিছু হটে। কিন্তু এরপরই হঠাৎ করে তীব্র পাল্টা আক্রমণ চালালে হতভম্ব হয়ে যায় ক্রুসেডাররা। ফলে নিশ্চিত বিজয় পরাজয়ে রূপ নেয়। ক্রুসেডারদের কমান্ডার হিউ সালাহউদ্দিনের বাহিনীকে আক্রমণের সময় আটক হন। মূল অবস্থানের দক্ষিণ প্রান্তের ছোট উপত্যকায় লড´াইয়ের পর জেনগিদের কেন্দ্রীয় শক্তি আগ্রাসী অবস্থানে চলে আসে। সালাহউদ্দিন পিছন থেকে তাদের সাথে যুক্ত হন। এ যুদ্ধে জেনগিরা বিজয়ী হয়। ইবনে আল আসিরের মতে সালাহউদ্দিন চাচা শেরকুহকে ইতিহাসের সবচেয়ে স্মরণীয় এই যুদ্ধ বিজয়ে সাহায্য করেন। তবে এতে শেরকুহর বাহিনীর অধিকাংশ সদস্য মারা যায়। সালাহউদ্দিন ও শেরকুহ এরপর আলেক্সান্দ্রিয়ার দিকে যাত্রা করেন। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা জানানো হয় এবং অর্থ, অস্ত্র প্রদান ও শিবির স্থাপন করতে দেয়া হয়। শহর অধিকার করতে এগিয়ে আসা একটি শক্তিশালী ক্রুসেডার বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য শিরকুহ তার সেনাবাহিনীকে বিভক্ত করেন। তিনি ও তার অধীনস্থ সেনারা আলেক্সান্দ্রিয়া থেকে অন্যত্র যাত্রা করেন এবং সালাহউদ্দিন ও তার অধীনস্থ সেনারা শহর রক্ষার জন্য থেকে যান।
মিশরের গভর্নর সালাহউদ্দিন সালাহউদ্দিনের দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে খলিফা আল আদিদ ১১৬৯ সালের ২৩ মার্চ ফাতেমী খেলাফতের অধীনে গভর্নর ও সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে তাকে মিশরে পাঠান। খেলাফতের উচ্চপদস্থ অনেকেই এই পদের জন্য লালায়িত ছিলো বিধায় শুরুতেই অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েন সালাহউদ্দিন। ভোগ-বিলাসে মত্ত আমির-ওমরা আর জেনারেলরা সালাহউদ্দিনের সম্মানে এক বিশাল ভোজসভার আয়োজন করে। নর্তকি আর নানান খাবারের বহর দেখে রাগান্বিত হয়ে পড়েন গভর্নর সালাহউদ্দিন। জানিয়ে দেন এইসব জিনিস তাকে খুশি করতে পারবে না। গদগদ হয়ে তারা জানতে চায় মহামান্য গভর্নর কোন জিনিস পেলে খুশি হবেন? ক্রুব্ধ সালাহউদ্দিন হেসে জবাব দেন ‘ক্রুসেডারদের লাশ’। তিনি কঠোর কণ্ঠে সবাইকে জিজ্ঞেস করেন, ক্রুসেডাররা যখন মুসলিম সাম্রাজ্যকে ইঁদুরের মতো কেটে টুকরো টুকরো করে চলেছে তখন আপনারা আমাদের মেয়েদের উলংগ করে মিশর থেকেও ইসলামকে বিদায় করতে চান? ফিলিস্তিন মুক্ত করার স্বপ্নে বিভোর সালাহউদ্দিনের জবাব শুনে নর্তকি আর মদের পেয়ালায় বুদ হয়ে থাকা জেনারেলদের ঘুম হারাম হয়ে যায়।
ক্রুসেডাররা যখন মুসলিম সাম্রাজ্যকে ইঁদুরের মতো কেটে টুকরো টুকরো করে চলেছে তখন আপনারা আমাদের মেয়েদের উলংগ করে মিশর থেকেও ইসলামকে বিদায় করতে চান?
ভোজসভায় জেনারেলদের উদ্দেশ্যে গভর্নর সালাহউদ্দিন সালাহউদ্দিন সেনাবাহিনীতে মদ ও নর্তকি নিষিদ্ধ করেন। সেনাবাহিনী থেকে গোত্রবাদ ও আঞ্চলিকতার প্রভাব দূর করতে তিনি একের পর এক পদক্ষেপ নিতে থাকেন। ফলে অসংখ্যবার সালাহউদ্দিনকে গুপ্তহত্যার চেষ্টা করা হয়। তবে তার পাশে ছায়ার মতো ছিলেন গোয়েন্দা প্রধান আলী বিন সুফিয়ান, যিনি সকল হত্যাচেষ্টা ব্যর্থ করে দেন। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর সকল বিজয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। শত্রুর পেট থেকে তথ্য বের করে নিয়ে আসার জন্য তার বাহিনী ছিলো অপ্রতিরোধ্য। সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর নির্দেশে ইতিহাসবিদ বাহাউদ্দিন ইবনে শাদ্দাদ রোমাঞ্চকর সেই কাহিনীগুলো তার ডায়েরিতে লিখে গেছেন।
১১৬৯ সালের শেষের দিকে নুরুদ্দিন জেনগির সাহায্যে দামিয়াতের কাছে বৃহৎ ক্রুসেডার-বাইজেন্টাইন সেনাবাহিনীকে পরাজিত করেন সালাহউদ্দিন। মিশরে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর সালাহউদ্দিন ১১৭০ সালে দারুম অবরোধের মাধ্যমে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেন। জেরুজালেমের খৃস্টান রাজা আমালরিক গাজা থেকে তার টেম্পলার বাহিনী সরিয়ে নেন এবং দারুম রক্ষার জন্য এগিয়ে আসেন।
কিন্তু সালাহউদ্দিন তার সেনাদের সরিয়ে নেন এবং গাজার দিকেই এগিয়ে যান। তিনি গাজায় প্রবেশ করে নাইট টেম্পলারদের জন্য খৃস্টান রাজা তৃতীয় বল্ডউইন কর্তৃক নির্মিত প্রাসাদ গুঁড়িয়ে দেন। সে বছরের ঠিক কবে এলিয়াতের ক্রুসেডার দুর্গ তিনি জয় করে নেন সেটা স্পষ্ট নয়। এটি আকাবা উপসাগরের একটি দ্বীপের উপর অবস্থিত ছিল। এটি মুসলিম নৌবাহিনীর যাতায়াতের জন্য হুমকি ছিল না। কিন্তু ক্ষুদ্র মুসলিম নৌবহরকে তা ব্যতিব্যস্ত রাখে বিধায় সালাহউদ্দিন এটি দখল করে নেন।
মিশর ও সিরিয়ার সুলতান সালাহউদ্দিন ১১৭১ সালের জুন মাসে নুরুদ্দিন জেনগি সালাহউদ্দিনকে মিশরে আব্বাসীয় খিলাফত প্রতিষ্ঠার কথা বলে চিঠি লেখেন। এ সময় কয়েকজন মিশরীয় আমির অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহে নিহত হন। ফাতেমী খলিফা আল আদিদকে বলা হয় যে, তাদেরকে বিদ্রোহের কারণে হত্যা করা হয়েছে। এরপর তিনি অসুস্থ হয়ে পড´েন। একটি সূত্র মতে তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়। অসুস্থ অবস্থায় তিনি তার সাথে দেখা করার জন্য সালাহউদ্দিনকে খবর পাঠান যেন তার সন্তানদের ঠিকমতো দেখাশোনা করা হয়। সালাহউদ্দিন আব্বাসীয়দের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার আশঙ্কায় তার সাথে দেখা করতে যাননি। কিন্তু আল আদিদ কী বলতে চেয়েছিলেন তা জানার পর তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন। পাঁচদিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর আল আদিদ মৃত্যুবরণ করেন। কায়রো ও ফুসতাতে আব্বাসীয় খলিফার নামে খুতবা পাঠ করা হয় এবং আব্বাসী খলিফা আল মুসতাদিকে খলিফা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ওই বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর সালাহউদ্দিন জেরুজালেম রাজ্যের মরু দুর্গ ক্রাক ও মন্ট্রিয়ালের উদ্দেশ্যে কায়রো ত্যাগ করেন। সিরিয়ার দিক থেকে এ সময় নুরুদ্দিন জেনগিও আক্রমণ চালান। তবে মন্ট্রিয়াল পৌঁছার পূর্বেই মিশরের বিদ্রোহের খবর শুনে সালাহউদ্দিন কায়রোতে ফিরে আসেন। এর ফলে নুরুদ্দিন একাই সেখানে লড়তে থাকেন। ১১৭৪ সালের মার্চে একটি ভূমিকম্পের পর বাগদাদে ফিরে আসেন নুরুদ্দিন। ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে যখন তিনি বিশাল এক বাহিনী প্রস্তুত করছিলেন ঠিক তখনই তাকে বিষপ্রয়োগ করা হয়। ১১৭৪ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে বিষপ্রয়োগের ফলে নুরুদ্দিন জেনগি ১১৭৪ সালের ১৫ মে মৃত্যুবরণ করেন। সিরিয়ার অভিজাত জেনগিরা নুরুদ্দিনের এগারো বছর বয়সী নাবালক পুত্র আস সালিহ ইসমাইল আল মালিককে সিংহাসনে বসায়। নুরুদ্দিনের মৃত্যুর ফলে সালাহউদ্দিন ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে তার সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র ও গুরুকে হারিয়ে ফেলেন। নুরুদ্দিনের পুত্র সালিহর কাছে লেখা চিঠিতে তিনি জানান যে, আপনি ও আপনার সমর্থকরা নুরুদ্দিনের নীতির অনুসরণ করলে এবং ক্রুসেডারদের সাথে মিত্রতা থেকে বিরত থাকলে সালাহউদ্দিন আপনার কাছে মাথা পেতে দিবে। কিন্তু নুরুদ্দিনের নাবালক পুত্র শাসক সালিহকে ঘিরে ক্রুসেডাররা নানা যড়যন্ত্র শুরু করে। শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন সালাহউদ্দিন। সিরিয়া ও আলেপ্পোতে জেনগিদের বিরুদ্ধে বিজয়ের পর সালাহউদ্দিন নিজেকে ওই অঞ্চলের শাসক ঘোষণা করেন। সালিহর নাম জুমার খুতবা ও মুদ্রা থেকে বাদ দেয়া হয়। বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফা সালাহউদ্দিনের ক্ষমতাপ্রাপ্তিকে স্বাগত জানান এবং তাকে মিশর ও সিরিয়ার সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন।
আপনি ও আপনার সমর্থকরা নুরুদ্দিনের নীতির অনুসরণ করলে এবং ক্রুসেডারদের সাথে মিত্রতা থেকে বিরত থাকলে সালাহউদ্দিন আপনার কাছে মাথা পেতে দিবে।
নুরুদ্দিন জেনগির পুত্র সালিহকে লেখা চিঠিতে সালাহউদ্দিন লক্ষ্য বাইতুল মোকাদ্দাস মুসলিম সাম্রাজ্যের আভ্যন্তরীণ কোন্দল আর আর ক্রুসেডারদের একের পর এক আক্রমণ স্বত্বেও লক্ষ্য থেকে মোটেও দূরে সরে যাননি সালাহউদ্দিন। বাইতুল মোকাদ্দাস পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ছক আঁকছিলেন এই বীর সেনাপতি। সুলতান সালাহউদ্দিন কায়রো ফিরে এসে এখানে তলোয়ার প্রস্তুতকারকদের কারখানা স্থাপন করেন এবং এখান থেকেই রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা শুরু করেন। ১১৭৭ সালের নভেম্বরে তিনি ফিলিস্তিনে আক্রমণ পরিচালনা করেন। এ সময় সালাহউদ্দিনের গোয়েন্দারা তাকে জানায় যে, ক্রুসেডাররা সিরিয়া আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। তিনি তার সেনাপতি ফররুখশাহকে তার এক হাজার সেনা নিয়ে দামেস্কের সীমানায় পাহারা দেয়ার নির্দেশ দেন। ১১৭৯ সালের এপ্রিলে খৃস্টান রাজা বল্ডউইনের নেতৃত্বাধীন ক্রুসেডাররা কোনো প্রতিরোধ হবে না ধরে নিয়ে সিরিয়ার গোলান মালভূমির পূর্বে মুসলিম পশুপালকদের উপর আচমকা হামলা হয়। ফররুখশাহর বাহিনীর উদ্দেশ্যে বল্ডউইন খুব দ্রুত যাত্রা করেন। কিন্তু ওঁত পেতে ছিলো ফররুখশাহের দল। তাদের মধ্যে সংঘটিত লড´াইয়ে আইয়ুবী বাহিনী জয়ী হয়। এ বিজয়ের পর সালাহউদ্দিন মিশর থেকে আরো সেনা আনার পরিকল্পনা করেন। এরপর একের পর এক যুদ্ধে খৃস্টানদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করতে থাকেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী।
১১৮৭ সালের জুলাই মাসে সালাহউদ্দিন ক্রুসেডারদের কিংডম অফ জেরুজালেম বা জেরুজালেম রাজ্যের অধিকাংশ এলাকা দখল করে নেন। ১১৮৭ সালের ৪ জুলাই হাত্তিনের যুদ্ধে জেরুজালেমের রাজা গাই অব লুসিগনান ও তৃতীয় রোনাল্ডের সম্মিলিত বাহিনীর সাথে সালাহউদ্দিনের বাহিনী মুখোমুখি হয়। যুদ্ধে ক্রুসেডার সেনাবাহিনী প্রায় সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ক্রুসেডারদের জন্য এটি একটি ভয়াবহ বিপর্যয় ছিল এবং ক্রুসেডের ইতিহাসে এটি গতি নিয়ন্ত্রক হিসেবে ভূমিকা পালন করে। রোনাল্ড অব শাটিলনকে বন্দী করা হয়। বেসামরিক মুসলিম ও হজযাত্রীদের উপর আক্রমণের কারণে সালাহউদ্দিন নিজে তাকে হত্যা করেন। বলা হয়ে থাকে, ইসলাম গ্রহণ করে তাকে তওবার সুযোগ দেন সুলতান। কিন্তু রোনাল্ড বলেন, একজন রাখালের ধর্ম গ্রহণ করা আমার মতো রাজার শোভা পায় না। রাসুল (স)-এর প্রতি অবজ্ঞা করে কথা বলায় ক্ষিপ্ত সালাহউদ্দিন তৎক্ষণাৎ তাকে হত্যা করেন। তার সাথে গাই অব লুসিগনানকেও বন্দী করা হয়। রোনাল্ডের পরিণতি দেখে তিনি আতঙ্কিত ছিলেন এই ভেবে যে হয়তো তাকেও মৃত্যুদন্ড দেয়া হবে। তবে সালাহউদ্দিন তাকে ক্ষমা করে দেন এবং বলেন যে, এক রাজা অন্য রাজাকে কখনও হত্যা করে না, কিন্তু ওই লোকটা সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল বিধায় আমি এমন আচরণ করেছি।
জেরুজালেম অবরোধ ও জয় ১১৮৭ সালের ২ অক্টোবর শুক্রবার সালাহউদ্দিনের সেনাবাহিনী দীর্ঘ অবরোধের পর ক্রুসেডারদের হাত থেকে জেরুজালেম জয় করেন। প্রায় ৮৮ বছর আগে যখন খৃস্টান টেম্পলাররা মুসলিমদের পরাজিত করে জেরুজালেম দখল করে নেয়, তখন গণহারে মুসলিমদের হত্যার করে। বলা হয়ে থাকে, মুসলিমদের রক্তে জেরুজালেমের রাজপথে প্রায় হাটুর সমান রক্ত প্রবাহিত হয়। অথচ সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবী চলি´শ দিন সময় দেন মুক্তিপণ দিয়ে নিরাপদে শহর ছেড়ে চলে যেতে। শহরের প্রত্যেক নারী, পুরুষ বা শিশুর জন্য সেসময়ে অনেক কম মুক্তিপণ ধার্য করা হয় (আধুনিক হিসাবে ৫০ ডলার)। অনেক পরিবার যারা মুক্তিপণ দিতে সক্ষম ছিল না তাদেরকেও তিনি মুক্তি দেন। জেরুজালেমের পেট্রিয়ার্ক হেরাক্লিয়াস বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেন যার মাধ্যমে ১৮,০০০ গরিব নাগরিকের মুক্তিপণ আদায় করা হয়। জেরুজালেম বিজয়ের পর সালাহউদ্দিন ইহুদিদের শহরে পুনরায় বসবাসের অনুমতি দেন। আসকালনের ইহুদি সম্প্রদায় তার এই ডাকে সাড´া দেয়। যুদ্ধের ময়দানে প্রতিপক্ষের উপর সিংহের মতো ঝাঁপিয়ে পড়া সেনাপতি শত্রুদের প্রতিও ছিলেন অত্যন্ত উদার। যুদ্ধের ময়দানে জ্বরে অসুস্থ হয়ে পড়া খৃস্টান রাজা রিচার্ডের জন্য পাঠিয়েছিলেন নিজের ব্যক্তিগত চিকিৎসক। এভাবেই জয় করেছিলেন ইংল্যান্ডের রাজা দ্য লায়ন হার্ট খ্যাত রিচার্ডের মন। ফলে সন্ধি করে ফিরে গিয়েছিলেন রিচার্ড।
এরপর প্রায় ৮০০ বছর বাইতুল মোকাদ্দাস মুসলিমদের অধীনেই ছিলো। শত আক্রমণ আর চক্রান্তের পরও পবিত্র এই শহরের দখল নিতে পারেনি ক্রুসেডাররা। সর্বশেষ উসমানী খলিফা সুলতান আব্দুল হামিদের নিকটও অনেক লোভনীয় প্রস্তাব দিয়েছিলো ক্রুসেডাররা। কিন্তু তিনি সব প্রস্তাব ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দেন, যতক্ষণ তার দেহে প্রাণ আছে তিনি মুসলিম উম্মাহর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না। তবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানী খেলাফত দূর্বল হয় পড়লে বৃটিশদের সহায়তায় আরব রাজ্যগুলো একের পর এক বিদ্রোহ শুরু করে। নিজেদের স্বাধীন আমির ঘোষণা দিয়ে তারা ফিলিস্তিন অঞ্চলে একটি ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বৃটিশ দাবি মেনে নেয়। ফলে ফিলিস্তিনিদের জমি জবর-দখল করে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা হয় অবৈধ রাষ্ট্র ইসরাইল। ১৯৬৭ সালে যারা বাইতুল মোকাদ্দাসের নিয়ন্ত্রণও গ্রহণ করে। আজও ফিলিস্তিনের আল-আকসা মসজিদ জায়োনিস্ট ইসরাইলের নিয়ন্ত্রণে। কিছুদিন পরপরই নিরস্ত্র ও নামাজরত মুসলি´দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়েনার দল। অবশ্য পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ফিলিস্তিনিরাও। পবিত্র বাইতুল মোকাদ্দাস ও ইসলামের প্রথম কেবলা পুনরুদ্ধারে এখনও সেখানে লড়াই বিদ্যমান।