• Wed. Dec 11th, 2024

দৈনিক পাবনার আলো, মাহফুজ আলী কাদেরী কর্তৃক সম্পাদিত

#pabnaralo#, pabna# pabnanews# পাবনারআলো# পাবনার_আলো#পাবনারখবর#পাবনারবার্তা

সেনা সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি সত্ত্বেও কেন হেরে যান নবাব সিরাজউদ্দৌলা?

গতকাল ছিল ঐতিহাসিক পলাশী দিবস। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রে হেরে যান বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। নবাবের পরাজয় ২০০ বছরের জন্য পুরো উপমহাদেশে বৃটিশ রাজত্বের পথ খুলে দেয়। দাসত্বের শেকলে বন্দী হয় এ অঞ্চলের মানুষ। নবাবের সেনা সংখ্যা বৃটিশদের তুলনায় কয়েকগুণ থাকা স্বত্বেও কেন হেরে গিয়েছিলেন সিরাজউদ্দৌলা? নির্মম সেই চক্রান্তের বিস্তারিত নিয়ে আমাদের আজকের আয়োজন।
উপমহাদেশের ভাগ্য নির্ধারণকারী এই যুদ্ধে নবাবের বাহিনীতে ৫০ হাজার সৈন্য ছিলো, অন্যদিকে ইংরেজ সেনা সংখ্যা ছিলো মাত্র ৩ হাজার। প্রকৃতপক্ষে, মীরজাফরের প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতার জন্যই এই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা হেরে যায়। সিরাজকে হারিয়ে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদ পৌঁছান এবং নবাবের সমস্ত ধন-দৌলত লুট করেন।
১৭২২ থেকে ১৭৫৬ সাল পর্যন্ত নবাব মুর্শিদ কুলি খান এবং নবাব আলীবর্দী খান বৃহত্তর বাংলা শাসন করেছিলেন। ১৭৫৬ সালে নবাব আলীবর্দীর মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলা নবাব হন। এতে মীরজাফর রাগান্বিত হয়ে পড়েন। তিনি ছিলেন সম্পর্কে আলীবর্দী খানের বোনের স্বামী। মনে মনে তিনি পরবর্তী নবাব হওয়ার আশা করেছিলেন। যার জন্য তিনি কাছে পেয়েছিলেন জগৎশেঠ, রায় বল-ভ ও আরো অনেককে। ঠিক এইরকম এক মোক্ষম সময়ে এসে হাজির হন বৃটিশ এজেন্ট রবার্ট ক্লাইভ। কারণ সেই সময় নবাবের সাথে ফরাসিদের বেশ ভালো সম্পর্ক আর ইংরেজদের সাথে খারাপ সম্পর্ক চলছিলো। সিরাজুদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে বসার পর প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ইংরেজরা নতুন নবাবকে কোনো উপটৌকন পাঠায়নি এবং তার সঙ্গে কোনো সৌজন্যেমুলক সাক্ষাৎ করেনি। এছাড়া ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নবাবের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গকে আরও শক্তিশালী করে এবং বাণিজ্য সম্প্রসারণে বিভিন্ন অনৈতিক পদক্ষেপ নেয় এবং জনগণের ওপর জুলুম শুরু করে যা ছিল কোম্পানির সাথে করা চুক্তির লঙ্ঘন।
ইংরেজদের এসব আচরণে নবাব ক্ষুব্ধ হন। এসব কারণে সিরাজের বাহিনী কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে নিয়েছিলো। তার নির্দেশে, ১৫৫ জন ইংরেজকে আটকে রাখা হয়। এই ঘটনা ক্লাইভ বৃটিশদেরকে জানিয়ে বাংলার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার অনুমতি পায়। এর ফলে ব্রিটেনের রাণী তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করেছিল। ১৭৫৭ সালের পলাশী যুদ্ধের আগেই বৃটিশ নৌবাহিনী সমুদ্রে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। বঙ্গোপসাগর ও ভারত মহাসাগর থেকে তারা ডাচদের উচ্ছেদ করেছিলো এবং ফরাসিদেরকেও কয়েকটি যুদ্ধে পরাজিত করেছিলো। একইভাবে তারা আমেরিকা, কানাডা, পশ্চিম আফ্রিকা এবং অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ তৈরি করেছিলো। এশিয়া ও আফ্রিকার মাধ্যমে একচেটিয়া দাস বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে ইংল্যান্ড এক সমৃদ্ধ শক্তিশালী সাম্রাজ্যে পরিণত হয়েছিলো। ততোদিনে ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কোলকাতা, মুম্বাই এবং মাদ্রাজের বন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলো কৌশলগতভাবে দখলে নিয়েছিলো। এসবের নেতৃত্ব দিয়েছিল চতুর ইংরেজ প্রশাসক রবার্ট ক্লাইভ।
২৩ জুন ১৭৫৭ সালে পলাশীর দুই বর্গমাইলব্যাপী আমবাগানে ব্রিটিশ সৈন্যরা সকাল থেকেই মুখোমুখি যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। বেলা আটটার সময় হঠাৎ করেই মীর মদন ইংরেজ বাহিনীকে আক্রমণ করেন। তার প্রবল আক্রমণে টিকতে না পেরে ক্লাইভ তার সেনাবাহিনী নিয়ে আমবাগানে আশ্রয় নেন। কিন্তু মীর জাফর, ইয়ার লতিফ ও রায় দুর্লভরা নিজেদের সেনাবাহিনী নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। তাদের সামান্য সহায়তা পেলেও হয়ত মীর মদন ইংরেজদের হারিয়ে দিতে পারতেন। দুপুরের দিকে হঠাৎ বৃষ্টি নামলে সিরাজউদ্দৌলার গোলাবারুদ ভিজে যায়। তবুও সাহসী মীর মদন এবং অপর সেনাপতি মোহন লাল ইংরেজদের বিরুদ্ধে লডাই চালিয়ে যেতে থাকেন। কিন্তু হঠাৎ করেই গোলার আঘাতে মীর মদন মারাত্মকভাবে আহত হন ও মারা যান। নবে সিং হাজারী ও বাহাদুর খান প্রমুখ গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধানও একইসাথে মৃত্যুবরণ করেন।
গোলন্দাজ বাহিনীর প্রধান নিহত হওয়ার পর সিরাজউদ্দৌলা মীর জাফর ও রায় দুর্লভকে তাদের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে তীব্র বেগে অগ্রসর হতে নির্দেশ দেন। কিন্তু উভয় সেনাপতি তার নির্দেশ অমান্য করেন। বিশ্বস্ত সেনাপতি মোহন লাল নবাবকে পরামর্শ দেন যুদ্ধ বন্ধ বা পিছু হটলে নিশ্চিত পরাজয় ঘটবে। কিন্তু নবাব সিরাজ মীর জাফর ও বৃটিশ দালালদের পরামর্শে পশ্চাৎপসরণের সিদ্ধান্ত নেন নবাব। বিকেল পাঁচটায় সিরাজউদ্দৌলার বাহিনী নির্দেশনার অভাবে এবং ইংরেজ বাহিনীর অগ্রসরতার মুখে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে অর্থাৎ পরাজয় স্বীকার করে। কোনো উপায় না দেখে সিরাজউদ্দৌলা রাজধানী রক্ষা করার জন্য ২,০০০ সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। কিন্তু রাজধানী রক্ষা করার জন্যেও কেউ তাকে সাহায্য করেনি। সিরাজউদ্দৌলা তার সহধর্মিণী লুৎফুন্নেসা ও ভৃত্য গোলাম হোসেনকে নিয়ে রাজধানী থেকে বের হয়ে উত্তর দিকে যাত্র শুরু করেন। তার আশা ছিল পশ্চিমাঞ্চলে পৌঁছাতে পারলে ফরাসি সেনাপতি মসিয়ে নাস-এর সহায়তায় পাটনা পর্যন্ত গিয়ে রাজা রামনারায়ণের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ করে ফরাসি বাহিনীর সহায়তায় বাংলাকে রক্ষা করবেন। কিন্তু তার সে আশা পূর্ণ হয়নি। সিরাজ পথিমধ্যে বন্দি হন ও মিরনের হাতে বন্দি অবস্থায় তার মৃত্যু ঘটে।
শত্রুকে ক্ষমা ও নবাবের অদূরদর্শিতা:
বৃটিশদের কূটচাল ও মীর জাফরদের বেঈমানিই কেবল এ যুদ্ধ পরাজয়ের পেছনে মূল কারণ ছিল না। নবাবের কিছু অদূরদর্শিতাও এতে প্রকাশ পেয়েছে। যেমন, পলাশীর যুদ্ধ শুরুর আগেই নবাব বিদ্রোহের আভাস পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মীর জাফর ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের বন্দী না করে তাদেরকে ক্ষমা করে দেন এবং নতুন করে শপথ নিতে বলেন। মীর জাফর পবিত্র কুরআন স্পর্শ করে শপথ নেন যে, তিনি শরীরের একবিন্দু রক্ত থাকতেও বাংলার স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন হতে দেবেন না। ঘরের ষড়যন্ত্র মীমাংসা করে নবাব রায় দুর্লভ, ইয়ার লতিফ, মীর জাফর, মীর মদন, মোহন লাল ও ফরাসি সেনাপতি সিনফ্রেঁকে সৈন্য চালানোর দাযিত্ব দিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করেন। এছাড়া জনগণের সাথেও তৎকালীন শাসকদের সম্পর্ক তেমন ঘনিষ্ঠ ছিল না বিধায় প্রজারা এই যুদ্ধকে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। ফলে ২০০ বছরের গোলামীর জিঞ্জির চেপে বসে তাদের গলায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *