• Fri. Oct 11th, 2024

দৈনিক পাবনার আলো, মাহফুজ আলী কাদেরী কর্তৃক সম্পাদিত

#pabnaralo#, pabna# pabnanews# পাবনারআলো# পাবনার_আলো#পাবনারখবর#পাবনারবার্তা

“বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ “-রওশন আক্তার রূপা

“বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ “

বঙ্গবন্ধুর মতোন মহৎ-নির্ভীক , আত্নপ্রত্যয়ী মহান নেতা এই বাংলার লাল-সবুজের জমিনে আর একটাও আসেনি ;আর কখনো আসবেও না। তাঁর দৃঢ়প্রত্যয় আর সাহসী তাৎক্ষণিক ভাষণগুলো শুনলে চক্ষু ভিজে যায়, লোমগুলো যেনো শিউরে ওঠে। এতোটা মনোবল তিনি কোথায় পেতেন। সাধারণ মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা তার মনোবলের একমাত্র উৎস ছিলো, আর সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলো মহান রব্বুল আলামিনের অপার রহমত। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যতোই পড়ি, ততোই জানার আগ্রহ জেগে ওঠে মনে। ততোই যেনো সম্মানে-শ্রদ্ধায় বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ি এই বিস্ময় মহামানবের প্রতি। তাঁকে নিয়ে লিখতে শুরু করলে যতোই লেখা হোক, তা সামান্যই মনেহয়।

বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির পিতা।
তুমি রেখেছিলে তোমার কথা।
‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব,
এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
৭১ এর ৭ই মার্চের তোমার এই বক্তৃতা
সত্যি হয়েছিলো ; হয়নিতো বৃথা।
তবু মনে প্রশ্ন জাগে, সত্যি কি পেয়েছিলে কাঙ্ক্ষিত সেই স্বাধীনতা?
পরাশক্তির হাত থেকে মুক্ত হলেও
রয়ে গেলো ঘরের শত্রু বিভীষণ,
স্বাধীন দেশে তাই মুক্ত হয়েও
স্বজাতি শত্রুর হাতেই দিতে হলো প্রাণ।

১৯৬৯ সালে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের সভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেয়া হয়। নানা শেখ আব্দুল মজিদ নাম রাখেন ‘শেখ মুজিবুর রহমান’। ছয় ছেলে-মেয়ের মধ্যে তৃতীয় এবং বড় ছেলে হওয়ায় মা-বাবা আদর করে ডাকতেন খোকা। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেয়া সেই ছোট্ট খোকা হয়ে ওঠেন বিশ্ব মানবতার মহান নেতা।

১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে গিমাডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষাজীবনের হাতেখড়ি। ১৯২৯ সালে তিনি গোপালগঞ্জ পাবলিক বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি হন। বাবা লুৎফুর রহমান চাকরির খাতিরে বদলি হয়ে ফরিদপুর যাওয়ার ফলে ১৯৩১ সালে মাদারিপুর ইসলামিয়া বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ১৯৩৪ সালে তিনি জটিল বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ফলে তাঁর হৃদপিণ্ড দুর্বল হয়ে যায়। ১৯৩৬ সালে তাঁর চোখে গ্লুকোমা ধরা পরলে জটিল অপারেশন করা হয়। দীর্ঘ সময় অসুস্থতায় ভোগান্তির ফলে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পড়ালেখা স্থগিত থাকে।সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হওয়ায় পর ১৯৩৮ সালে গোপালগঞ্জের মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজ (বর্তমান নাম মাওলানা আজাদ কলেজ) থেকে আই এ পাশ করেন ১৯৪৪ সালে। তিনি ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে ১৯৪৭ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। দেশ ভাগের পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ভর্তি হন। সেখানে কর্তৃপক্ষের অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি তাঁর প্রতিবাদী মননশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন প্রতি পদক্ষেপে। ২০১০ সালে সে বহিষ্কার আদেশ তুলে নেয়া হয়।

১৯৩৮ শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ বছর বয়সে শেখ ফজিলাতুন্নেসা (রেনু)’র সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা এবং তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল এর জনক-জননী ছিলেন তাঁরা।

ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার বাবার উপদেশ মেনেছেন অক্ষরে অক্ষরে। তিনি তাঁর বাবার কথা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘বাবা রাজনীতি কর আপত্তি করব না, পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ এ তো সুখের কথা, তবে লেখাপড়া করতে ভুলিওনা। লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবেনা। (অসমাপ্ত আত্মজীবনী:পৃষ্ঠা: ২০)’’।

শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী’র সান্নিধ্য এবং তার অপরিসীম ধৈর্যশীলতার গুণে তিনি হয়ে ওঠেন আরেক মহান নেতা।১৯৪৪ সালে বঙ্গ মুসলিম ছাত্রলীগের সম্মেলনে যোগদানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক রাজনীতিতে যুক্ত হন। কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে পড়ার সময় বঙ্গবন্ধু ১৯৪৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সহকারী হিসেবে নিযুক্ত হওয়ার ফলে প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলিম লীগের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন ইতিহাসবিদ বঙ্গবন্ধুকে “সোহরাওয়ার্দীর ছত্রতলে রাজনীতির উদীয়মান বরপুত্র” হিসেবে আখ্যায়িত করতেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও নেতৃত্বেই আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। রাজনৈতিক গুরু শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটলেও পরবর্তীতে নিজের রাস্তা তিনি নিজেই তৈরি করে নিয়েছেন, নিজেকে পরিণত করেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী হিসেবে।
১৯৬৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ছয় দফা কে দলীয় কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করে এবং ছয় দফা’র পক্ষে জনমত সংগঠিত করতে দেশব্যাপী একের পর এক জনসভা করেন। ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ছয় দফা কর্মসূচি ‘ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন বঙ্গবন্ধু। ছয় দফা ঠেকাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বহু ষড়যন্ত্র করেছে , তবুও তিনি অনড় থেকেছেন। একই সালের ২০ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি বলেন, “কোনো হুমকিই ছয় দফা আন্দোলনকে প্রতিরোধ করতে পারবেনা। ছয় দফা হচ্ছে বাঙালির মুক্তিসনদ।”

বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ শব্দ দুটো একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বঙ্গবন্ধু না থাকলে আজকের বাংলাদেশ হয়তো আমরা পেতাম না। বাংলাদেশ শব্দের মূলেই রয়েছেন শেখ মুজিব। তৎকালীন সময় আমাদের দেশের নাম ছিলো পূর্ব পাকিস্তান যার শাসন ব্যবস্থা ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে। যদিও আমাদের দেশটা পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় সম্পদ ও জনবলে সমৃদ্ধ ছিলো তথাপিও আমাদের স্বাধীনতা ছিলোনা। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার লুন্ঠন এবং এদেশের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করাই ছিলো তাদের কাজ। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় ৫২ সালে পশ্চিম পাকিস্তানিরা ব্যর্থ হয়। ছাত্রদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয় বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গৌরবময় অধ্যায়, যা স্বাধীনতার পথে প্রথম সোপান হিসেবে কাজ করে। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আওয়ামী লীগের আলোচনা সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে ‘বাংলাদেশ’।

এর পরদিন অর্থাৎ ১৯৬৯ সালের ৬ ডিসেম্বর দেশের বিভিন্ন পত্রিকায় এ অঞ্চলের নাম ‘বাংলাদেশ’ নামকরণের খবর ছাপা হয় এবং আতাউর রহমান খান ‘পাকিস্তান অবজার্ভার’-এ বঙ্গবন্ধুর এই নামকরণের প্রতি সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি দেন। এ ছাড়া ন্যাপের আধ্যাত্মিক গুরু মওলানা ভাসানী ৭ ডিসেম্বর প্রকাশ্য জনসভায় পূর্ব পাকিস্তানের পুনঃনামকরণ সমর্থন করে বলেন, ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণই হবে ঠিক এবং যথার্থ। তিনিও যুক্তি দেন, যেহেতু এক ইউনিট ভেঙে গেছে, তাই ‘বাংলাদেশ’ নামটি পুনরুজ্জীবিত হওয়া উচিত।
এর পর থেকে নথিপত্রগুলোয় পূর্ব পাকিস্তান লিখতে হলেও কেউ মুখে পূর্ব পাকিস্তান উচ্চারণ করতেন না। সবাই বলতেন বাংলাদেশ। সবাই এ অঞ্চলকে বাংলাদেশ হিসেবেই মনে-প্রাণে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রচার করে, তাতেও বলা হয়- এই দেশটির নাম হলো ‘বাংলাদেশ’। তা ছাড়া কালুরঘাট থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণায়ও স্বাধীন দেশের নাম বাংলাদেশ-ই উল্লেখ করা হয়।১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় এবং বিজয় লাভ করে। এরপর ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর যখন প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয় সে সময় দেশটির সাংবিধানিক নাম দেওয়া হয় ‘বাংলাদেশ’।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি, উল্টো তারা আঁকতে থাকে ষড়যন্ত্রের নীল নকশা। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তর না করার সিদ্ধান্তের ফলে পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলন গড়ে ওঠে।।১৯৭১ সালের ১লা মার্চ হোটেল পূর্বানীতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় সদস্যদের অধিবেশন চলাকালে আকস্মিকভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। সমস্ত বাংলা ক্ষোভে ফেটে পড়ে, বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয় রাজপথ। বঙ্গবন্ধু এটাকে শাসকদের আরেকটি চক্রান্ত বলে চিহ্নিত করেন। তিনি ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারা পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল আহবান করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন, যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের নিপীড়ন ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, ” এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। “
তিনি আরো বলেন, ” প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।”
বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণটি যখনি শুনি, তখনি মুগ্ধতায় ডুবে যাই। কতোটা সাহসী মনোভাব থাকলে এভাবে বলা যায়, তা অনুভব করি। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতার আন্দোলন আরো জোরদার হয়। তাঁর এই ভাষণটি বাঙালি জাতির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকে নতুন মাত্রা দেয়,স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বাঙালি জাতিকে তীব্রভাবে অনুপ্রাণিত করে।

এরই মধ্যে পাক হানাদার বাহিনী ২৫ মার্চ মধ্য রাতে এদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং দেশের সর্বস্তরের মানুষের উপর গনহত্যা চালায়।ঢাকায় এক রাতের সে অভিযানে অর্ধ লক্ষ মানুষের প্রাণহানী হয়েছিল, সেই রাতটিকে স্বাধীন বাংলাদেশে বর্ণনা করা হয় ‘কালরাত্রি’ হিসেবে।পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতের ওই সেনা অভিযানের সাংকেতিক নাম বা কোডনেম দিয়েছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’।
এই অভিযানটির পরিকল্পনা করা হয়েছিল তারও এক সপ্তাহ আগে, ১৮ই মার্চ।সময়টা ছিল রাজনৈতিকভাবে উত্তেজনাপূর্ণ। গণপরিষদের অধিবেশন স্থগিত করায় ঢাকা তখন বিক্ষোভের শহর। ঢাকায় ইতিমধ্যে ওড়ানো হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। এরই মধ্যে ৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দিয়েছেন। ডামি রাইফেল নিয়ে ঢাকার রাস্তায় মার্চ করছেন ছাত্র-ছাত্রীরা।

মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সেই রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গ্রেফতার করা হল আরও ৩ হাজার লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমস্ত পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চললো মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করলো ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট। লুট আর ধ্বংস যেন তাদের নেশায় পরিণত হল। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শেয়ালের খাবারে পরিণত হল। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠলো শকুন তাড়িত শ্মশান ভূমি।’

পাইকারি এই গণহত্যার স্বীকৃতি খোদ পাকিস্তান সরকার প্রকাশিত দলিলেও রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সম্পর্কে যে শ্বেতপত্র পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রকাশ করেছিল, তাতে বলা হয়: ‘১৯৭১ সালের পয়লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত ১ লাখেরও বেশি মানুষের জীবননাশ হয়েছিল।’
গণহত্যার রাতেই গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। গ্রেফতার হওয়ার আগেই ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে রাত সাড়ে বারোটার সময় বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেস যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পুনরায় পাঠ করা হয়। সারাবিশ্বে খবর ছড়িয়ে যায়, বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হতে চলেছে।
তিনি তার ভাষণে বলেন, æএটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের মানুষকে আহ্বান জানাই, আপনারা যেখানেই থাকুন, আপনাদের সর্বস্ব দিয়ে দখলদার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধ চালিয়ে যান। বাংলাদেশের মাটি থেকে সর্বশেষ পাকিস্তানি সৈন্যটিকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের আগ পর্যন্ত আপনাদের যুদ্ধ অব্যাহত থাকুক।”

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর সারা পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার স্মরণে প্রতি বছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয়।

১৪ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী ঢাকার মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থান গ্রহণ করে। ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশে অবস্থিত পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার সামনে আত্নসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করে। সেদিন প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্নসমর্পণ করেছিলো, যা ছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় বিজয়। এই দিনে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্নসমর্পণের মাধ্যমে বিশ্বমানচিত্রে জন্ম নেয় নতুন রাষ্ট্র “বাংলাদেশ”।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া হয়। দেশে ফেরার পর ১২ জানুয়ারি তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করেন।তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটাকে নতুন করে গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন, কিন্তু পরাজিত হায়েনার দল তাঁর সাফল্য ও বাঙালির উত্থানকে মেনে নিতে পারেনি। দেশ যখন সকল বাধা দূরে ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছিলো তখন দেশীয় ষড়যন্ত্রকারী ও আন্তর্জাতিক চক্রের শিকারে পরিণত হন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সামরিক বাহিনীর তৎকালীন কিছু উচ্চাভিলাষী ও বিপথগামী সৈনিকের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। তবে বঙ্গবন্ধু কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দেশের বাইরে অবস্থান করার ফলে তাদের হত্যা করতে ব্যার্থ হয় এই স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি। ১৫ আগস্টের সেই কালো রাত বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বিষাক্ত ক্ষত, যা কোনোকালেই শুকাবে না।
মাত্র চারবছর আগেই যিনি তাঁর অকুতোভয় নেতৃত্বে জন্ম দিলেন বাংলাদেশের, কৃতজ্ঞতার বদলে তাঁরই স্বদেশবাসীরা ক্ষমতার নোংরা খেলায় মাতাল হয়ে নির্মমভাবে হত্যা করলো তাঁকে।এই হত্যাকান্ডে যারা জড়িত ছিলো তারা শুধু দেশকে এক মহান নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত করেনি, বরং বঞ্চিত করেছে একটি স্বপ্ন;একটি আদর্শকে।বঙ্গবন্ধুর অকাল প্রয়াণের খবর প্রকাশ হওয়ার পর কেঁপে ওঠে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো, মুজিবহীন বাংলাদেশের কথা ভাবতেও পারছিলোনা কেউ। তাঁদের কাছে বঙ্গবন্ধু মানেই বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুকে দিয়েই তাঁরা বাংলাদেশকে চিনেছিলো।গণমাধ্যমগুলোতে দুঃখজনকভাবে প্রচার হচ্ছিলো এই নৃশংস হত্যাকান্ডের খবর।
“শেখ মুজিব নিহত হলেন তার নিজেরই সেনাবাহিনীর হাতে অথচ তাকে হত্যা করতে পাকিস্তানিরা সংকোচবোধ করেছে” – বিবিসি-১৫ আগস্ট ১৯৭৫।
” মুজিব না থাকলে বাংলাদেশ কখনই জন্ম নিত না” – ফিন্যান্সিয়াল টাইমস।
আচমকা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর শুনে কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, – ” আমি হিমালয় দেখিনি, বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। শেখ মুজিবের মৃত্যুতে বিশ্বের শোষিত মানুষ হারালো একজন মহান নেতাকে, আমি হারালাম একজন অকৃত্রিম বিশাল হৃদয়ের বন্ধুকে।”

স্বাধীনতার অগ্রদূত এই মহান নেতার জীবন প্রদীপ এতোটা ঠুনকো অবস্থানে ছিলো, তা সত্যিই অভাবনীয়।

Bangabandhu's political genius revealed in March 7 Speech | News |  Bangladesh Sangbad Sangstha (BSS)

মা-বাবার আদরের ডাকনাম ‘খোকা’,
ভালোবেসে পাষাণেরা দিয়েছিল ধোকা।
নিকষ অন্ধকার শ্রাবণ ধারায়,
ঝড়েছিলো মহান সে প্রাণ ঘাতকের ইশারায়।
তাঁর দেখানো পথে চলি,
তাঁর শেখানো মুখের বুলি,
পরাধীনতার শিকল ভাঙার শপথ তুলি,
স্বাধীনতার মুক্ত সুখের হাসি পেলো বীর বাঙালি।
যারা চুমেছিলো গর্বে তাঁরই চরণধূলি,
কেমনে তারা নিঠুর হলো ভালোবাসার বাঁধন ভুলি।
যেই বুকেতে ফুটে ছিলো আমজনতার সোহাগ মাখা ফুলের কলি,
বেঈমানেরা সেই বুকেতেই গেঁথে দিলো শোকের গুলি।

বাংলাদেশের আজকের এই স্বাধীনতার অগ্রনায়কের প্রতি, মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ হারানো, আর ক্ষতিগ্রস্ত সকল আত্মত্যাগীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা-সম্মান জ্ঞাপন করি। সেই সাথে আমাদের দেশটা যেনো সত্যিই স্বাধীন আর সোনার বাংলায় রূপ নেয় সেই কামনা করি।
আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাঙালি জাতিকে স্বাধীন ভূখণ্ড উপহার দেন এই ভূমিপুত্র। ছোট্ট খোকা থেকে হয়ে ওঠেন জাতির পিতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু কোনো ব্যক্তির নাম নয়, বাংলাদেশের প্রতিধ্বনি।

রওশন আক্তার রূপা
প্রভাষক, টেবুনিয়া মহিলা কলেজ, পাবনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *