• Wed. Dec 11th, 2024

দৈনিক পাবনার আলো, মাহফুজ আলী কাদেরী কর্তৃক সম্পাদিত

#pabnaralo#, pabna# pabnanews# পাবনারআলো# পাবনার_আলো#পাবনারখবর#পাবনারবার্তা

পদ্মাসেতু সমাপ্ত ঃ এখন প্রয়োজন আরিচা-নগরবাড়ীর সেতু

সুসংবাদ আমাদের দেশের মানুষের কপালে বড় একটা জোটে না। দুঃসংবাদই আমাদের দেশে খবর। বলা যায়, একমাত্র খবর। দেশের সংবাদপত্রগুলির পাতা উল্টালেই চোখে পড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত মানুষের সংখ্যা, চোখে পড়ে রেল বা লঞ্চ দুর্ঘটনার খবর, নদীপথে ফেরী আটকে থাকায় হাজার হাজার যাত্রী মাঝপথে গভীর অনিশ্চয়তায় নিক্ষিপ্ত হওয়ার খবর, নারী ধর্ষণের খবর, মাদ্রাসার ছাত্রদের তাদেরই শিক্ষক কর্তৃক বলাৎকারের খবর, মৌলবাদীদের হুমকির খবর এবং ১০টি মাস ধরে করোনা ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর বা আক্রান্ত হওয়ার খবর, কল-কারখানা বন্ধ করে দেওয়া এবং হাজার হাজার শ্রমিকের বেকারত্ব প্রাপ্তির খবর, পণ্যমূল্য বৃদ্ধির খবর, সীমাহীন দুর্নীতির খবর। একই চিত্র আমাদের টিভি চ্যানেলগুলিও প্রচার করে পত্রিকায় প্রকাশের আগের দিন।
এত কিছু দুঃসংবাদে থাকতে থাকতে মনও আর এখন তেমন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে না। সবই যেন গা-সহা হয়ে গেছে।
এর মধ্যে সুসংবাদ এলো গত ১০ ডিসেম্বরে। তাৎপর্য্যময় সুসংবাদ বিজয় দিবসের সপ্তাহ খানেক আগে। পদ্মাসেতুর ৪১ তম অর্থাৎ শেষ স্প্যানটি বসানো হলো। মনের প্রফুল্লতা বহুদিন পরে ফিরে এলো। এর একক কৃতিত্বের দাবীদার আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁকে অভিনন্দন।
অভিনন্দন আগেও জানিয়ে ছিলাম তাঁকে-যখন বিশ^ব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, জাইকা প্রমুখ দাতা সংস্থা এই প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ করতে অস্বীকৃতি জানানোর সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রত্যয় ঘোষণা করে বললেন, নিজস্ব অর্থায়নেই পদ্মা সেতু প্রকল্পের বাস্তবয়ন করা হবে। খবরটি জানা মাত্র প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলাম উৎসাহ দিয়েছিলাম নিজ অর্থায়নেই যেন করা হয়। বাংলাদেশ নিজের পায়ে যে দাঁড়াতে পারে-বিশে^র দরবারে তা প্রমাণিত হোক।
অবশেষে তা হলো। পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। এখন তো জোর গলায়ই বলতে পারি, পদ্মা সেতুর মত

ব্যয়বহুল এবং এশিয়ার বৃহত্তম সেতু যখন নিজ অর্থায়নে নিজস্ব সম্পদের উপর দাঁড়িয়ে করতে পেরেছি-তখন জোর দিয়েই বলা যায় আমরা আরও পারব-আরও করবো।
আমি এখন একটি বহু পুরাতন দাবীর উল্লেখ করবো। এ দাবী পূরণে বঙ্গবন্ধু রাজী ছিলেন কিন্তু সময় পান নি। দাবীটি হলো নগরবাড়ী আরিচা এবং আরিচা-দৌলতদিয়া ওয়াই (ণ) প্যাটার্নের সেতু। এই সেতু নির্মাণ নিয়ে বহুবার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছিল। যাচাই এর ফলাফলও ছিল ইতিবাচক। এই সেতু প্রকল্পে লাভবান হতে পারেন উত্তর-দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ। উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, শাহ্জাদপুর, মানিকগঞ্জ ও ঢাকা এবং সেই গঞ্জে কুষ্টিয়া, যশোর ও খুলনা ও ঢাকার দূরত্ব বেশ কমে যাবে। যাত্রী চলাচল বৃদ্ধি পাবে, সহজতর হবে। তেলের খবর কমে আসবে অর্ধেকে, পণ্য চলাচলও বৃদ্ধি পাবে এবং সহজতর হবে এবং তার প্রভাবে পণ্যমূল্য নদীর উভয় পাড়ে কমে আসবে। যমুনা সেতুর উপর ক্রমবর্ধমান চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে।
এই প্রকল্পটি গ্রহণের দাবী, তার বাস্তবায়নের দাবী বহু পুরাতন। বঙ্গবন্ধু, ছাড়াও শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও এই দাবীতে সোচ্চার ছিলেন এবং আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। শহীদ মনসুর আলী মন্ত্রী থাকাকালে তিনিও এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক চাপ ছিল নগরবাড়ী-আরিচায় না করে

সেতুটি সিরাজগঞ্জ-টাঙ্গাইল অর্থাৎ যমুনা সেতু যেখানে নির্মিত হয়েছে-সেখানে সেতুটি নির্মাণ করা।
কিন্তু জনগণের চাপ বাড়তে থাকে নগরবাড়ী আরিচার অনুকূলে। ব্যবসায়ী শিল্পপতিরাও তাই চান। জনগণের ক্রমবর্ধমান চাপে বছর দশেক আগে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সচিব, প্রকৌশলী সহ দুই ঘাটে দলে বলে এসে সম্ভাব্যতা যাচাই করে নগরবাড়ি-আরিচা সেতু নির্মাণের পক্ষে সুষ্পষ্ট অভিমনত প্রকাশ করেন।
অত:পর সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এবং তাঁর নিকটবর্তী এলাকার একজন রাষ্ট্রমন্ত্রী সুপারিশ ঈশ^রদী-পাবনা-সুজানগর-আমিনপুর-বেড়া-ঢালারচর হয়ে ঢালার চর-মানিকগঞ্জ সেতু নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। সে অনুযায়ী ঢালারচর পর্য্যন্ত (ঈশ^রদী থেকে পাবনা হয়ে) একটি সিঙ্গল লাইন রেল লাইন স্থাপন করা হয়েছে মাত্র। সেতু নির্মাণের কোন কাজ হাতে নেওয়া হয় নি।
এই পরিস্থিতিতে এটা স্পষ্ট অযৌক্তিক রাজনৈতিক চাপে নগরবাড়ী-আরিচা সেতু (রেলপথ ও অন্যান্য সংযোগ সম্পন্ন) বারবার আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে, প্রকল্পটি কার্য্যকর করার জন্য হাতে নেওয়া হয় নি। এই দুঃখজনক চাপের নেপথ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলির সন্তান-যাঁরা উচ্চপদস্থ আমলা হিসেবে সড়ক, সেতু ও রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন বা আছেন-তাঁদেরও হাত রয়েছে। অপরপক্ষে রেলওয়ে সিঙ্গল লাইন নির্মাণ করে বা ডবল লাইন না করার কারণে পাবনা ঢাকা বা ঢাকা-আরিচা-নগরবাড়ী-পাবনা-ঈশ^রদী সরাসরি রেল চলাচলের সুযোগ থাকছে না

দেখে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলির মানুষ বিক্ষুব্ধ। এই বিক্ষোভ তাঁরা রেলমন্ত্রীকে জানানোতে তিনি আস্বাস দিয়েছেন প্রকল্পটি যথাযথবাবে প্রণয়ন করতে।
এখন বাংলাদেশের সকল অঞ্চলের মানুষ আনন্দে ভাসছেন হাজারো প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে অবশেষে পদ্মাসেতুর মূল নির্মাণ কাজ ৪১ তম স্প্যান বসানোর মাধ্যমে সাফল্যের সাথে সমাপ্ত হলো। একমাত্র দৃঢ় চিত্ততা ও নিষ্ঠাকে অবলম্বন করেই এই কাজটি বাস্তবায়িত হলো। যে যে কাজ এখন বাকী থাকছে তার মধ্যে রেলওয়ের পাত বসানো, বিদ্যুতায়ন, সেতুর উভয় পাশে এপ্রোচ রোড নির্মাণ, নিরাপত্তা কর্মীদের আবাসস্থল, থানা ভবন ও টেলিপ্লাজা নির্মাণ প্রভৃতি। এতে বছর দেড়েক সময় লেগে যেতে পারে।
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ হওযায় এবং দিনে দিনে মানুষ নানা কাজে বহির্মূখী হওয়ায় এক স্থান থেকে অপর স্থানে চলাচল প্রভৃতি বৃদ্ধি পাছে। যমুনা সেতুই তার প্রমাণ। ঐ সেতু যখন মানুষ ও যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়, তখন যে সংখ্যক যান চলাচল করতো বিগত কয়ে বছরের মধ্যে তার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে দ্বিগুণের কাছাকাছি পৌঁছেছে। প্রতি দিনই তা যেমন বাড়তে থাকবে, তেমনই সেতুর স্থায়ীত্বের ক্ষেত্রেও বাড়তি চাপ ও ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে। ইতোমধ্যেই বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, বিপুল চাপের ফলে যমুনা সেতুর কোন কোন স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে তা অবশ্য মেরামতও করা হয়েছে। কিন্তু ঐ সেতুর উপর থেকে চাপ না কমাতে পারলে

আগামী কয়ে বছরের মধ্যে সেতুটিকে নিয়ে কঠিন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
এই সকল পরিস্থিতি পর্য্যালোচনা ও বিবেচনা করে কালবিলম্ব না না করে বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন কালে প্রকল্পটি অনুমোদন করে আগামী ২০২১-২২ অর্থ বছরের বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ করা প্রয়োজন।
পদ্মা সেতু বা যমুনা সেতু নির্মাণ অপেক্ষা আরিচা-নগরবাড়ী সেতু, রেল সংযোগ স্থাপন সহ নানাবিধ ব্যয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম পড়বে। কারণ ঢাকা-আরিচা এবং ঈশ^রদী-নগরবাড়ী সড়ক পথ বহু আগে থেকেই ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধুমাত্র তা আর দু’তিন ফুট করে প্রসস্ত করার জন্য যথেষ্ট কম পরিমাণে জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। অপরদিকে ঈশ^রদী-পাবনা-ঢালারচর সিঙ্গেল রাইন রেলপথ নির্মাণ ও রেল চলাচলও এক বছরের বেশী আগেই চালু করা হয়েছে। এখন এই রেলপথকে ডাবল লাইনে পরিণত করে নগরবাড়ী পর্য্যন্ত নিয়ে যেতে খুব একটা বেশী রাজস্ব ব্যয়ের প্রয়োজন পড়বে না।
অপরদিকে ঢাকা-আরিচা প্রশস্ত সড়ক পথে যানবাহন বহু বছর আগে থেকেই চালু রয়েছে। ঐ পথকে ৩-৪ ফুট প্রশস্ত করে রেলপথ নির্মাণ করাও তুলনামূলকভাবে কম ব্যয়ের প্রয়োজন হওয়ার সম্ভাবনা।
কিন্তু সর্বাগ্রে প্রয়োজন আরিচা-নগরবাড়ী সেতু নির্মাণ।
সড়ক-সেতু ও রেল মন্ত্রণালয় এ প্রকল্পটি গ্রহণে তৎপর হবেন বলে প্রায় দুই কোটি মানুষের প্রত্যাশা।

(লেখক: রণেশ মৈত্র, একুশে পদক প্রাপ্ত সাংবাদিক)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *