কুরবানির ঈদ এলেই দেশে গরু ও ছাগল কেনার হিড়িক পড়ে যায়। এ ছাড়া অতিরিক্ত মুনাফার আশায় একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী দীর্ঘদিন ধরে শহরাঞ্চলে ধোঁকা দিয়ে রাতের অন্ধকারে মহিষের মাংসকে গরুর মাংস আর ভেড়াকে ছাগল (খাসি) বলে বিক্রয় করছে। শহরে প্রতিদিন অনেক মহিষ দেখতে পাওয়া যায়; কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে, মহিষের মাংস কিনতে গেলে পাওয়া যায় না।
মূলত মাংস ব্যবসায়ীরা রাতে গোপনে মহিষ জবাই করে গরুর মাংস হিসাবে সিল মেরে ঝুলিয়ে রাখে। মহিষ জবাইয়ের পর প্রথমেই গোপন জায়গায় নিয়ে গিয়ে শিং উঠিয়ে শরীর থেকে চামড়া খুলে নেওয়া হয়। পরে তা বিভিন্ন দোকানে গরুর মাংস হিসাবে সরবরাহ করা হয়। ভেড়া জবাইয়ের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম অনুসরণ করা হয়। অপরদিকে গরু ও খাসির মাংস বলে প্রমাণ করার জন্য মাংস বিতানের সামনে গরু ও ছাগলের মাথা, চামড়াসহ বিভিন্ন আলামত রাখা হয়, যেন মানুষ সহজেই বিশ্বাস করে।
মহিষের মাংসের দাম আমাদের দেশে তুলনামূলকভাবে গরুর মাংসের চেয়ে কম হওয়ার কারণে ভোক্তাদের অনেকের মধ্যে মহিষের মাংস সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা রয়েছে। যদিও গরুর চেয়ে মহিষের মাংস ও দুধের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি। হয়তো এ কারণে চট্টগ্রামের কিছু কিছু এলাকায় মহিষের মাংস বেশ জনপ্রিয় এবং অনেকে গরুর পরিবর্তে মহিষ দিয়ে কুরবানি দিতেও পছন্দ করে। এভাবে দেশের সর্বত্র সবাই যদি মহিষের মাংস ও দুধের পুষ্টিগুণ ও স্বাস্থ্যসম্মত গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন হতো, তাহলে অধিক সংখ্যক মানুষ মহিষ পালনে যেমন উৎসাহিত হতো, তেমনিভাবে এর দুধ ও মাংসের ব্যাপারেও আগ্রহী হতো।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) এবং যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগসহ (ইউএসডিএ) আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার গবেষণায় দেখা গেছে, গুণগত মানের দিক দিয়ে গরুর দুধ ও মাংসের তুলনায় মহিষের দুধ ও মাংস বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। মহিষের দুধে এমন কিছু উপাদান রয়েছে, যা মানব শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। মহিষের দুধ ঘন ও ননিযুক্ত হওয়ায় এটি ইয়োগার্ট বা দই, পনির, ননিযুক্ত মিষ্টি উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী। এ ছাড়া ঘি, মাখনসহ বিভিন্ন দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনেও এর জুড়ি নেই। এ ছাড়া গরুর দুধের তুলনায় মহিষের দুধ অনেক বেশি সময় ধরে সংরক্ষণ করা যায়। মহিষের মাংসে কলস্টেরলের পরিমাণ মুরগির চেয়েও কম। এতে ক্যালরি ও প্রয়োজনীয় চর্বিজাতীয় উপাদান গরুর দুধের তুলনায় অনেক বেশি। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ খনিজ ও ভিটামিনের উপস্থিতির কারণে মহিষের দুধ গরুর তুলনায় বেশি স্বাস্থ্যসম্মত ও বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক।
খাদ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, মহিষের দুধে গরুর দুধের তুলনায় ক্যালসিয়াম, আয়রন ও ফসফরাসের মাত্রা যথাক্রমে ৯২, ৩৭ দশমিক ৭ ও ১১৮ শতাংশ বেশি। এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন মহিষের মাংসের চাহিদা বাড়ছে। মহিষের মাংস গরুর তুলনায় কিছুটা শক্ত, তবে বেশি স্বাস্থ্যসম্মত। উভয় মাংসের স্বাদ প্রায় একই রকম হলেও মহিষের মাংসে প্রোটিন তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। গরুর মাংসে চর্বির পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হলেও মহিষের মাংসে তা মাত্র ২ শতাংশ। অন্যদিকে গরুর তুলনায় মহিষের মাংস কম লাল হলেও মহিষের মাংসে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে।
সরকারের পক্ষ থেকে যদি গরুর চেয়ে মহিষের মাংস ও দুধের পুষ্টিগুণ অনেক বেশি-এ ধারণাটি ভোক্তাদের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেওয়া যায, তবে মহিষের মাংসকে গরুর মাংস বলে বিক্রয়ের প্রবণতা যেমন কমবে, তেমনি কমবে ভোক্তাদের সঙ্গে প্রতারণা এবং মহিষের দুধ ও মাংসের চাহিদা দিন দিন বাড়বে; দেশও অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভবান হবে।