॥ মাওলানাঃ শামীম আহমেদ ॥ আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর জীবনে একবার হজ ফরজ করেছেন। এ মর্মে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, হজ পালনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর এ নির্দেশ পালিত হয়।
আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন : হজের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। কেননা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই মুসলমানরা ঐতিহাসিক পবিত্র মরুপানে ছুটে যায়। যেমন- ‘এবং মানুষের মধ্যে হজের জন্য ঘোষণা প্রচার কর। তারা তোমার কাছে আসবে পায়ে হেঁটে এবং সর্বপ্রকার কৃশকায় উটের পিঠে সওয়ার হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে।’ (সূরা আল হাজ্জ : আয়াত-২৭)।
আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের উপায় : হজ পালনের মাধ্যমে আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করা যায়। ইহরাম, তাওয়াফ, তালবিয়া কোরবানিসহ হজের যাবতীয় অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে মানব-মন আল্লাহ-প্রেমে গভীরভাবে আকৃষ্ট হয়। ফলে বান্দা তার প্রভুর নিবিড় সান্নিধ্য প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে পারে।
পাপ মোচন : যথাযথভাবে হজ পালন করলে আল্লাহ বান্দার সব গুনাহ মাফ করে দেন। এ প্রসঙ্গে মহানবী (সা.) বলেন, ‘পানি যেমন ময়লা-আবর্জনা ধুয়ে-মুছে পরিচ্ছন্ন করে দেয় হজও তদ্রূপ গুনাহ বিদূরিত করে পবিত্র করে দেয়।’
জাহান্নামের শাস্তি থেকে পরিত্রাণ : হজ জাহান্নামের আগুন থেকে পরিত্রাণ দেয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ যাকে হজব্রত পালনের সামর্থ্য দিয়েছেন সে যদি হজ না করে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে সে জাহান্নামের ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক আগুনে নিক্ষিপ্ত হবে।’
ধর্মবিশ্বাসে দৃঢ়তা : মুসলমানরা নিজেদের ধনসম্পদ ও আত্দীয়স্বজনের মায়া পরিত্যাগ করত আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থে পবিত্র কাবাঘরের উদ্দেশে পাড়ি জমান। সুতরাং হজ মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসকে দৃঢ় করে।
নবী প্রেমের বাস্তব প্রতীক : হজের মাধ্যমে মহানবী (সা.)-এর স্মৃতি বিজড়িত অনেক স্থান প্রত্যক্ষ করা যায়। এতে রাসূল (সা.)-এর প্রতি ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। ইরশাদ হচ্ছে, ‘যে আমাকে ভালোবাসবে সে আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে।’ (তিরমিযি)
হজরত ইবরাহিম আলায়হিস সালামের স্মৃতিস্মারক : হজ মুসলিম মিল্লাতের পিতা, হজরত ইবরাহিম আলায়হিস সালাম, দ্বিতীয় স্ত্রী হজরত হাজেরা আলায়হিস সালাম ও পুত্র হজরত ইসমাঈল আলায়হিস সালামের স্মৃতিস্মারক। হজ পালনের মাধ্যমে তাদের ত্যাগের
কাহিনী মুসলমানদের স্মৃতিপটে ভেসে উঠে। কোরআনের ভাষায় : ‘নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহতায়ালার নিদর্শনগুলোর অন্যতম।’ (সূরা আল বাকারা- : আয়াত-১৫৮)
আল্লাহভীতি অর্জন : হজ পালনের মাধ্যমে বান্দা আল্লাহর প্রতি গভীর মনোযোগী হয়। এ অবস্থায় সে প্রতিটি কাজে আল্লাহকে ভয় করে চলে।
হজ আল্লাহমুখী করে তোলে : হজ মানুষকে যাবতীয় স্বার্থ, লোভ-লালসা, গোত্র, বর্ণ, ভাষা আর ভৌগোলিক সীমারেখার ঊধ্র্বে এক আল্লাহর সান্নিধ্যমুখী তথা ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে।
ঐক্য ও বিশ্বভ্রাতৃৃত্ব সৃষ্টি : হজের সময় মুসলমানরা বিশ্বভ্রাতৃত্বের নবপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে একতাবদ্ধ হয়। এ ঐক্য এতই পূর্ণাঙ্গ যে, এখানে প্রভু ও ভৃত্যের মাঝে কোনো পার্থক্য সৃষ্টি করা যাবে না।
বিশ্ব মুসলিমের বৃহত্তম সম্মেলন : হজ মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ঐক্য সম্মেলন। অন্য কোনো কারণে এত অধিক সংখ্যক মুসলমান কখনো একত্রিত হয় না।
একতাবোধের উন্মেষ ঘটায় : হজ কেবল ঈমানকেই বলিষ্ঠ করে না; বরং এটা সমগ্র মুসলিম জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করার পন্থা হিসেবেও কাজ করে। যেমন- ইরশাদ হচ্ছে, ‘আর তোমরা সকলে আল্লাহর রজ্জুকে সুদৃঢ় হস্তে ধারণ কর, পরস্পর বিচ্ছিন্ন হইও না।’ (সূরা আল-ইমরান : আয়াত -১০৩)
বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ সৃষ্টি : হজের সময় ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মিল, পোশাকের মিল, জীবনযাত্রায় মিল, অনুভূতির মিল, দৃষ্টিভঙ্গির মিল- এ প্রত্যেকটি বিষয়ই মুসলমানদের বিশ্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধ উন্নয়নে সাহায্য করে।
দীন কায়েমের দৃপ্ত শপথ গ্রহণের শক্তিশালী মাধ্যম : মুসলমানদের রাজনীতি হবে কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। হজের মাধ্যমে মুসলমানগণ মহান আল্লাহ জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত শপথ নিতে পারে। ইরশাদ হচ্ছে, ‘তোমরা দীনকে প্রতিষ্ঠিত কর এবং তাতে অনৈক্য সৃষ্টি করো না।’ (সূরা আশ-শুরা : আয়াত-১৩)
আল্লাহর খিলাফত প্রতিষ্ঠা : হজ পৃথিবীতে ইসলামী খিলাফতের আদর্শে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেরণা জোগায়। আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদের বললেন, আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি।’ (সূরা আল বাকারা : আয়াত ৩০)
ভৌগোলিক জ্ঞান লাভ হয় : হজ হাজীদের ভৌগোলিক জ্ঞানের সীমা সম্প্রসারিত করে। হজ বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক অবস্থান, জলবায়ু, রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান লাভের সুযোগ সৃষ্টি করে। কাজেই হজ মুসলমানদের ভাবগত ও কৃষ্টিগত প্রগতির পথে এক বলিষ্ঠ পদক্ষেপ।
মুসলিম বিশ্বের উন্নতি সাধনের মহাসুযোগ : হজ সমাপনের পরে বিভিন্ন মুসলিম রাষ্ট্রের সামাজিক, অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে পরস্পর আলাপ-আলোচনা ও ধারণা বিনিময় করার মাধ্যমে মুসলিম বিশ্বের উন্নতি সাধন করা সম্ভব হয়।
মুসলিম বিশ্বে একতা সৃষ্টিকারী : সমগ্র মুসলিম জাহানকে ঐক্যবদ্ধ করতে হজের ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্ব মুসলিমের ওপর যে নির্যাতন চলছে তার অবসানকল্পে মুসলমানদের ঐক্য পূর্বশর্ত এবং সব মুসলিম রাষ্ট্রের রাজনীতির ধারা একই রকম হওয়া অপরিহার্য। হজ সবাইকে একই সূত্রে গেঁথে ঐক্য ও সহাবস্থান সৃষ্টির প্রতি আহ্বান করে।
সাম্যের বিকাশ সাধন : হজে উঁচু-নিচু, রাজা-প্রজা, মনিব-ভৃত্য, আরব-অনারব, ধনী-দরিদ্র সবাই একই প্রকারের পোশাক পরিধান করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভেদাভেদের সব প্রাচীর ভেঙে সাম্যের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান প্রভুর বিধান পালন করে থাকে। হজ ব্যতীত পৃথিবীর অন্য কোনো অনুষ্ঠানে সাম্যের এ নজির পরিদৃষ্ট হয় না।
পারস্পরিক সম্প্রীতি সৃষ্টি : হজের এ আন্তর্জাতিক সম্মিলনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে লাখ লাখ মুসলমান পবিত্র মক্কা নগরীতে একত্রিত হয়। এ সময় তাদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ, ভাবের আদান-প্রদান ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়। ফলে তাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক, সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতি বৃদ্ধি পায়।
শৃঙ্খলাবোধ জাগ্রত : সমগ্র বিশ্বের মুসলমান হজের প্রতিটি কাজ নিয়মতান্ত্রিকভাবে পালন করে শৃঙ্খলাবোধের পরিচয় দেয়। সমাজজীবনে এ শৃঙ্খলাবোধের গুরুত্ব সীমাহীন।
বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টি : হজ বিশ্বভ্রাতৃত্ব সৃষ্টিতে অতুলনীয় ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুসলমানরা এ সময় মক্কা শরিফে একত্রিত হয়ে জাতি, গোত্র ও বর্ণভেদ ভুলে একই ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়।