।। এবিএম ফজলুর রহমান।।
আজ (২৬ সেপ্টেম্বর) প্রখ্যাত সাংবাদিক, কলামিষ্ট ও রাজনীতিক রণেশ মৈত্রর
প্রথম প্রয়ান দিবস। গত বছর ২৬ সেপ্টেম্বর সোমবার ভোররাতে একুশে
পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও কলামিষ্ট রণেশ মৈত্র (৯০) ঢাকার পপুলার হাসপাতালে
পরলোকগমন করেন। তার প্রথম প্রয়ান দিবসে সন্ধ্যায় পাবনা প্রেসক্লাবে
স্মরণ সভা ও দুপুরের পরিবারের পক্ষ থেকে পাবনার মহাশক্ষ্মানে একটি
বিশ্রামাগার উদ্বোধন করা হবে। মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ
বিভিন্ন জনস্বার্থের আন্দোলনে সব সময় সাহসি ভুমিকা রাখেন। ১৯৩৩
সালের ৪ঠা অক্টোবর তাঁর মাতামহের চাকুরীস্থল রাজশাহী জেলার ন’হাটা
গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আজীবন সংগ্রামী রণেশ মৈত্র। বাবা রমেশ চন্দ্র
ছিলেন পাবনার আতাইকুলা থানার ভুলবাড়িয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন
শিক্ষক। ২০১৮ সালে তিনি সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন। তার স্ত্রী
পুরবী মৈত্র বীরমুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশ মহিলা সমিতি পাবনা জেলা শাখার
সাবেক সভানেত্রি।
সপ্তম শ্রেণীতে উঠার পর থেকেই তিনি টিউশনী করে নিজের লেখাপড়ার খরচ
চালান। নিজ জীবন সংগ্রাম থেকে শিক্ষা নিয়েই রণেশ মৈত্র দেশের অসহায়,
শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের জন্য আন্দোলন ও সংগ্রাম করেন। ১৯৫০ সালে
জিসিআই স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৫৫ সালে পাবনা
এডওয়ার্ড কলেজ থেকে আইএ এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন
করেন। ১৯৪৮ সালে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দিয়ে ভাষা আন্দোলনের মিছিলে
যোগ দেয়ার মধ্য দিয়েই শুরু হয় তার রাজনৈতিক জীবন।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি পাবনা জেলার অন্যতম সংগঠক ছিলেন।
সেই বছরেই তিনি ছাত্র ইউনিয়নের জেলা সাংগঠনিক কমিটির সভাপতি
নির্বাচিত হন। ১৯৫৩ সালে এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে
অংশ নিয়ে সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক
আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে তিনি
বাংলাদেশ অবজারভারের আব্দুল মতিন, কামাল লোহানী, প্রসাদ রায়,
আনোয়ারুল হকসহ প্রগতিশীল বন্ধুদের সাথে গঠন করেন শিখা সংঘ নামে
একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। যে সংগঠনের একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার
ছিল সেখান থেকে শিখা নামে একটি হাতে লেখা পত্রিকাও প্রকাশিত হত।
ভাষা আন্দোলন, ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন সহ পাক স্বৈরশাসকের
বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য তিনি বহুবার কারা বরণ করেন। ১৯৫৫ সালে জেল
থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি আওয়ামীলীগে যোগদান করেন। ১৯৫৭ সালে
মাওলানা ভাষানীর নেতৃত্বে ন্যাপে যোগ দেন। পরে ১৯৬৭’র দিকে তিনি
মোজাফ্ধসঢ়;ফর আহমেদের নেতৃত্বাধীন রাশিয়াপন্থী ন্যাপে যোগদান করেন।
দীর্ঘদিন ন্যাপের প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন
করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক হিসেবেও তিনি দায়িত্ব
পালন করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তৎকালীন জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের
খান জেলার প্রগতিশীল বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে একটি
সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটিরও রনেশ মৈত্র ছিলেন একজন
অন্যতম সদস্য। ১৯৯৩ সালে তিনি ড. কামাল হোসেনের সাথে গণফোরামে
যোগ দেন এবং প্রেসিয়াম সদস্য হন। তিনি দীর্ঘদিন গণফোরামের
প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে ২০১৩ সালে ঐক্য
ন্যাপে যোগ দেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ঐক্য ন্যাপের প্রেসিডিয়াম
সদস্য ছিলেন।
১৯৫১ সালে সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল পত্রিকায়
সাংবাদিকতার মাধ্যমেই তার সাংবাদিকতা জীবন শুরু হয়। এরপর কলকাতা
থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগে তিন বছর সাংবাদিকতার পর ১৯৫৫
সালে তিনি যোগ দেন দৈনিক সংবাদে। ১৯৬১ সালে ডেইলি মর্নিং
নিউজ এবং ১৯৬৭ সাল থেকে তিনি ১৯৯২ সাল পর্যন্ত দৈনিক অবজারভারে
পাবনা প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯২ সালে দি নিউ নেশনের মফস্বল
সম্পাদক হিসেবে যোগ দেয়ার পর ১৯৯৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত তিনি দি
ডেইলী স্টারের পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেন। পরে তিনি স্বেচ্ছায়
অব্যাহতি নিয়ে একজন ফ্রি-ল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে দেশের শীর্ষ পত্র
পত্রিকায় কলাম লিখে সারা দেশে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন।
এ ছাড়া ১৯৬১ সালে পাবনায় পূর্ব পাকিস্তান মফস্বল সাংবাদিক সম্মেলনের
মাধ্যমে গঠিত পুর্ব-পাকিস্তান সাংবাদিক সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ
সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই সম্মেলনের মাধ্যমে মফস্বল সাংবাদিকরা তাদের
পেশার স্বীকৃতি পায়। তিনি সেই বছরেই প্রতিষ্ঠিত পাবনা
প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হন। এছাড়া তিনি দীর্ঘদিন
প্রেসক্লাবের সভাপতি ও সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে জেলার সাংবাদিকদের
নেতৃত্ব দিয়েছেন।
সফল আইনজীবী হিসেবেও দীর্ঘদিন তিনি দায়িত্ব পালন করেন। পরে আইন
পেশা থেকেও স্বেছায় অবসর নেন। রণেশ মৈত্র মুত্যর আগেরদিন পর্যন্ত কলাম
লিখেছেন। করোনাকালীণ দীর্ঘ দেড় বছর ঘরবন্দি থেকে কিছুটা বিষন্ন
হয়ে পড়েছেন। তবে থেমে রয়নি তার কলম।
গত বছরের ২৬ সেপ্টেম্বর পাবনা প্রেসক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, ভাষা
সংগ্রামী মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক একুশে পদকপ্রাপ্ত
সাংবাদিক ও কলামিষ্ট রণেশ মৈত্র পরলোকগমন করেন। তিনি স্ত্রী
বীরমুক্তিযোদ্ধা পুরবী মৈত্র, দুই ছেলে ও তিন মেয়েসহ অসখ্য গুনগ্রাহী রেখে
গেছেন।
তার প্রকাশিত গ্রন্থ’ রুদ্র চৈতন্যে বিপন্ন বাংলাদেশ পাঠক মহলে
সমাদ্রিত হয়েছে। তার প্রথম প্রয়ান দিবসে সন্ধ্যায় পাবনা প্রেসক্লাবে
স্মরণ সভা ও দুপুরের পরিবারের পক্ষ থেকে পাবনার মহাশক্ষ্মানে একটি
বিশ্রামাগার উদ্বোধন করা হবে। লেখক : এবিএম ফজলুর রহমান, স্টাফ
রির্পোটার দৈনিক সমকাল ও সভাপতি পাবনা প্রেসক্লাব।
এবিএম ফজলুর রহমান
স্টাফ রির্পোটার, পাবনা অফিস
২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ইং