লিখতে বসেছি সীতাকু-ে মৃত্যুর মিছিল নিয়ে-আকাশ ছোঁয়া অগ্নিশিখা নিয়ে-সমুদ্রভরা অশ্রুজল নিয়ে আর দেশ-বিদেশের লাখো কোটি মানুষের মানবিকতা নিয়ে। কিন্তু লেখা এগুচ্ছে না। সর্বদাই চোখের সামনে ভেসে ওঠে টেলিভিশন চ্যানেলগুলি কর্তৃক প্রচারিত দাউ দাউ করে জ¦লা আগুনের ছবি, বিষ্ফোরণের আওয়াজ, অসংখ্য মৃতদেহ, আহত ও সকল ভুক্তভোগীর প্রিয়জনদের আর্ত কান্না ও আহাজারি। এর পর লেখা কি করে এগোয়।
এখন বারবারই যেন মনে হয়, আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশটি বড়ই দুর্ভাগা একটি দেশে পরিণত হয়েছে। দেশটি যেন সব সম্ভবের দেশে পরিণত হয়েছে। মানুষের জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তাও নেই।
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি, আরও কতই না ভয়াবহ অগ্নিকা- নিকট অতীতে ঘটে গেছে। এবারের মত এক বা একাধিক তদন্ত কমিটিও গঠিত হয়েছে-সরকার তাদের তদন্ত পরবর্তী রিপোর্টও পেয়েছেন জনমতের চাপে মামলাও দায়ের হয়েছে কিন্তু বিচারালয় বা আদালতের দরজায় সেগুলি গিয়ে পৌঁছে নি। কোথায় এবং কেন যেন থমকে যায় সব কিছু। আমাদেরও ভুলে যেতে খুব একটা দেরী হয় না।
সীতাকু- নতুন করে সেগুলি মনে কমিয়ে দিল। প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদের স্মরণে আনতে ওই ঘটনাগুলির উল্লেখযোগ্য ভয়াবহ ঘটনাসমূহের সংক্ষিপ্ত কথা উল্লেখ করছি। পুরোনো তথধ্য ঘেঁটে দেখা গেছে-
এক. দেশে হতাহতের দিক দিয়ে এখন পর্য্যন্ত বড় ধরণের ঘটনা ঘটেছিল ২০১০ সালের ৩ জুন রাতের বেলায় পুরান ঢাকার নিমতলিতে সংঘটিত ওই ঘটনায় মর্মান্তিক মৃত্যুর শিকার হয়েছিলেন ১২৪ জন, দগ্ধ হন দুই শতাধিক মানুষ। রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা সেই আগুনের লেলিহান শিখা সেই আগুনের লেলিহান শিখা বাতাসের সঙ্গে উড়ছিল নিমতলি এলাকার সুরু গলির বাতাশের সঙ্গে। পুরো একটি মহল্লার বাসাবাড়িতে ছড়িয়েছিল সেই আগুন। এত বড় ট্রাজেডির ঘটনায় কোন মামলা হয়েছিল কি না তা মনে পড়ছে না। তবে কেউ যে গ্রেফতার হয় নি এবং আজ তক কারও যে এতটুকুও শাস্তি হয় নি আজও তা জোর দিয়েই বলা যায়। তদন্ত কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী গত ১২ বছরেও পুরাতন ঢাকা থেকে সরে নি একটি রাসায়নিক গুদামও। গুদামগুলির মালিকেরা দিব্যি নিরাপদে নিশ্চিন্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে-স্বাভাবিক জীবনও যাপন করছে।
দুই. এর দুই বছর পর ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর মানুষ ফের দেখে আগুনের ভয়াবহতা। ওই দিন ঢাকার আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে ‘তাজরিন ফ্যাশান’ নামক গার্মেন্টেস্ লাগা আগুনে প্রাণ হারান ১৭ জন শ্রমিক। দগ্ধ ও আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। ওই অগ্নিকা-ের পর তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসে কারখানা ভবনটির নানা অসঙ্গতি। ওই ঘটনায় জনমতের চাপে মামলা হলেও গত ১০ বছরেও বিচার শেষ হয় নি। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক দেলোয়ার হোসেনব গ্রেফতার হলেও কারাগারে থেকে বেরিয়ে তিনি এখন ঢাকায় বড় রাজনৈতিক দলের সহযোগি সংগঠনের বড় নেতা। আর পায় কে?
তিন. ২০১৯ সালে ২০ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়ি হাট্টায় ফের ঘটে ভয়াবহ অগ্নিকা-। এবারও বাসাবাড়িতে গড়ে ওঠা রাসায়নিকের গুদাম থেকে লাগা ওই আগুনে প্রাণ হারান ৭১ জন। চুড়িহাট্টার অলিগলিতে ছড়িয়ে পড়া সেই আগুনে পথচারীরাও হতাহত হন। ওই ঘটনায় দায়ের মামলার আসামীদের বিরুদ্ধে দুই বছর পর অভিযোগপত্র দিলেও এখন পর্যন্ত বিচারকাজ শুরুই হয় নি।
চার. গত বছর ২০২১ সালের ৮ জুলাই নারায়গঞ্জের রূপগঞ্জে হাশেম ফুড কারখানায় ভয়াবহ আগুনে প্রাণ হারান ৫১ জন শ্রমিক। ওই আগুনে দগ্ধ হন ও আহন হন অর্ধশত মানুষ। ফায়ার সার্ভিস সহ বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে কারখানা ভবনের নানা অনিয়ম বেরিয়ে এলেও শাস্তি পেতে হয় নি কাউকেই।
পাঁচ. একই বছরের ২৪ ডিসেম্বর ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে যাত্রীবাহি লঞ্চে ভয়াবহ আগুন লাগে। অভিযান-১০ নাম ওই লঞ্চে লাগা ওই আগুনে প্রাণ হারান ৩৮ জন যাত্রী। দগ্ধ হন অন্ত ৭০ জন। ব্যস, ওই পর্যন্তই।
ছয়. ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীতে অবস্থিত ট্যাম্পাকো ফয়েলস প্যাকেজিং নামে একটি কারখানায় ভয়াবহ আগুনে প্রাণ হারান ৩১ জন শ্রমিক। ওই আগুনে দায়ীদেরও শাস্তি পেতে হয় নি।
সাত. ২০১৯ সালে রাজধানীর বনানীতে বহুতল এফ আর টাওয়ারের ভয়াবহ আগুনে প্রাণ হারান ২৬ জন। আহন ও দগ্ধ হন ৭০ জন। ভবনটি নির্মাণ থেকে সুরু করে রক্ষণাবেক্ষণে নরানা ত্রুটি বেরিয়ে আসে তদন্ত প্রতিবেদনে। ওই ঘটনায় মামলা দায়ের হলেও পুলিশ তিন বছরেও তদন্ত শেষ করতে পারে নি, আদালতে জমা পড়ে নি কোন চার্জশীট। বিচার কবে হবে কি হবে না-তা কেউ জানে না।
আট. ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় প্রাইম প্লাষ্টিক কারখানার ভয়াবহ আগুনে ১৭ জন শ্রমিক নিহত হন। ওই ঘটনায়েও বিচারের মুখোমুখি হতে হয় নি দায়ীদের।
নয়. ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে একটি দোকানে বিষ্ফোরণ থেকে সৃষ্ট আগুণে প্রাণ হারাতে হয় ১২ জনকে। ওই বিষ্ফোরণের পর সড়কে গাড়িতে থাকা লোকজন ও পথচারী সহ অন্তত ১০০ জন আহত হন। আশপাশের ভবনগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে এমন ঘটনার দায় কার-তাও খুঁজে বের করা হয় নি।
এ ছাড়াও ২০০৯ সালের ৩ মার্চ রাজধানীর পান্থপথে অভিজাত শপিং মল বসুন্ধরা সিটিতে অগ্নিকা-ে সাতজন প্রাণ হারান। এর দুই বছর আগে ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কারওয়ান বাজারে বিএসইসি ভবনে আগুনে মারা যান তিন জন। এর কোনটির জন্যেই দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা বা তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলা আজও দায়ের করা হয় নি।
আবার সীতাকু-
এবারে ফিরে আসা যাক সীতাকু-ের মর্মান্তিক অগ্নিকা-ে। ৬ মে বিকেল পর্যন্ত প্রাপ্ত টি.ভি. প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, মৃতের সংখ্যা ৪৯ এই স্থিতি। তবে আহত চিকিৎসাধীনদের মধ্যে সবাই বাঁচতে সমর্থ হবেন এমন আশাবাদ চিকিৎসকেরাও প্রকাশ করছেন না-বরং তাঁরা শংকিত ওআি চিকিৎসাধীনদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক দগ্ধ নিয়ে। কিছু সংখ্যকের সন্ধান মিলছে না।
সীতাকু-ের ঘটনায় দলমত ধর্ম সম্প্রদায় নির্বিশেষে দেশবাসী যে সহমর্মিতা-মানবিকতা দেখিয়েছে তা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। যেমন যে বিপুল পরিমাণ রক্তের প্রয়োজন হয়েছে-তাই সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় মানুষজন লাইন ধরে দাঁড়িয়ে দিয়েছে। যে বিপুল পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হতো ওষুধ কিনতে সহমর্মি হাজার হাজার নারী-পুরুষ তা আগ্রহ সহকারে তুলে দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তদের স্বজনদের হাতে। এখন কি, ওষুধের দোকানদাররাও অনেকে সম্পূর্ণ বিনা পয়সায় প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ করছেন।
অবাক বিস্ময়ে এ-ও দেখলাম, কোন কোন বিদেশী প্রতিষ্ঠান সীতাকু- অগ্নিকা-ে ক্ষতিগ্রস্ত গার্মেন্টস্ কারখানা থেকে তাদের আমদানীর আদেশের পণ্য পুড়ে গিয়ে থাকলে তার পূর্ণ মূল্য শোধ করবে বলে ইতোমধ্যেই জানিয়েছে। এভাবেই তারা ক্ষতিগ্রস্ত গার্মেন্টস্ মালিকদের বিপদে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তবে, পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে প্রশ্ন তুলে রাখি বিদেশী কোম্পানীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি গার্মেন্টস্ কারখানাগুলিকে টাকা দিলেও, শ্রমিকেরা তাদের প্রাপ্য টাকা পাবেন কি?
একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, চট্টগ্রামের সীতাকু-ে বিএস কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ে রফতানির অপেক্ষায় থাকা বিপুল পরিমাণ তৈরী পোষাক পুড়ে গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল সুইডেন ভিত্তিক ব্রা- এইচ এ- এম এর। বিশ^খ্যাত এই ব্র্যা- নিজেদের রফতানি আদেশের বিপরীতে ক্ষতিগ্রস্ত সব পণ্যের মূল্য পরিশোধ করবে। এইচ এ- এমের আনুমানিক ৫০ লক্ষ পিস পোষাক পণ্য ওই ডিপোতে
ছিল বলে জানা গেছে।
বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলির এমন সহমর্মিতা যেমন প্রশংসার তেমনই আবার দেশী কারখানাগুলির পক্ষ থেকেও যেন বিদেশী কোম্পানীগুলির অবদান স্মরণে রেখে তাঁদের কারখানা ভবন সমূহকে যথেষ্ট নিরাপদ ভবনে দ্রুত পরিণত করা-অগ্নি নির্বাপণের সর্বাধুনিক ব্যবস্থাদি প্রতিটি কারখানা ভবনে গ্রহণ করা, যাঁরা প্রাণ দিয়েছেন তাঁদের কথা স্মরণে রেখে তাঁদের ও আহতদের সকলের পরিবার পরিজনকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানই শুধু নয়-ওই পরিবারগুলিকে নিজ পায়ে দাঁড়ানোর ব্যবস্থাও সর্বতোভাবে করা প্রয়োজন। এই নৈতিক দাবী কদাপি ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না।
বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বলেছেন, সীতাকু- ঘটনার জন্য দায়ী কেউ পার পাবে না।
বাংলাদেশের একটি মানুষও কি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর এই কথায় বিন্দুমাত্র আশ^স্ত হবেন? এই প্রহসনমূলক কথা তিনি না বললেও পারতেন।
বিনীতভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলি অতীতের সকল অগ্নিকা-ের বিচার তবে কেন হলো না? সেগুলির বিচারও একই সাথে করা হবে তো? পুলিশ কি সহসা কারও বিরুদ্ধে বা দায়ী সকলের বিরুদ্ধে চার্জশীট দেবে? অতীতের ঘটনাগুলিতে দিল না কেন?
(লেখক: রণেশ মৈত্র,
সাংবাদিকতায় একুশে পদক প্রাপ্ত)